বুধবার, ৬ মে, ২০২০

করোনা, লকডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি –০১

করোনা, লকডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি –০১


সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
WhatsApp Image 2020-04-18 at 7.12.40 AM
প্রত্যন্ত এলাকায় ইঁট ভাটির মালিকের দেওয়া ত্রাণসামগ্রী নিতে শ্রমিকদের ভিড়। ছবি: সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
চিনের উহান থেকে যে অদৃশ্য শত্রু মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করার দুরভিসন্ধি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলো সে আমাদের ঘরের কাছেই এসে হানা দিয়েছে। আচমকা এই আক্রমণে যখন সবাই সন্ত্রস্ত তখন কেউ কেউ এর প্রতিকারে হাস্যকর সমাধানও দিয়ে যাচ্ছিলেন। এরা মানুষ নিয়ে কারবার করেন। তাই করোনা পরবর্তী অবশিষ্ট পৃথিবী যদি হাতছাড়া হয়ে যায় এই ভয় মৃত্যুভয় থেকেও তাদের বেশি তাড়িত করে। আবার অনেকেই ভেবেছিলেন সব পীঠস্থান বন্ধ হয়ে গেছে, এবার বিজ্ঞানের জয় সুচিত হবে আর অন্ধকার দূর হবে। কিন্তু কই? করোনা মানুষকে চিনতেই পারলনা, মানুষ তার দুর্বলতা বুঝে নিল – এই ভেবে অবসর বিনোদনের ফাঁকে কারবার গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো একদল মানুষ। বিদ্বেষ ছড়ানো, মিথ্যা প্রচার, রাজনৈতিক প্রোপাগেণ্ডা ইত্যাদি শুরু হয়ে গেলো জোরকদমে। এদিকে মৃত্যুর সঙ্গে অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লড়ে যাচ্ছে কেউ, কেউ হেরে যাচ্ছে, কেউ জয়ী হয়ে ফিরছে ম্লানমুখে। আরেকটি দল মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে এক পরিচিত শত্রুর বিরুদ্ধে। সেই শত্রু হল ক্ষুধা। কিন্তু ক্ষুধায় যে মানুষ মরে এই সত্য এদের অনেকেই কোনোদিন কল্পনাও করেনি। সেই কল্পনার অতীত বাস্তব সামনে এসে দাঁড়ালো ভীষণ মূর্তি নিয়ে। অনেকের অনেক স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল – বিয়ে করবে, ছেলেমেয়ে মানুষ করবে, বার্ধক্য কাটবে নিশ্চিন্তে অথবা নিজের সঙ্গে আর দশটা পরিবার চলবে। সব কর্পুরের মত ধীরে ধীরে চোখের সামনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
দাস পদবির এক পরিবার আমাদের গ্রামে ভাড়া থাকে। বাড়ি অনেক দূর। স্বামী-স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে চার জনের পরিবার। কর্তা মিষ্টি দোকানের কর্মচারি। কোনোদিন কারো কাছে হাত পাততে হয়নি। লকডাউন ঘোষিত হলো, বাড়ি ফেরা হলো না। এখন কী অবস্থা সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের গ্রাম একধরণের স্যাটেলাইট ভিলেজ। বেশির ভাগ লোক খেত খামার ছেড়ে দিয়েছে সেই কবে। এই প্রজন্ম আর এসবে নেই। কেউ চাকরি করে, কারো পাইকারি ব্যবসা আছে। তারপর কেউ দালালি করে পেট চালায়, কেউ চা-পান বিক্রেতা, সব্জি বিক্রেতা, দোকানি, বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আর রয়েছেন দিনমজুর, চাষি, মৎস্যজীবী ইত্যাদি। গরিব পরিবারের ছেলেরা দেশে বিদেশে কষ্টার্জিত পয়সা দিয়ে বাড়ির চেহারা পাল্টাচ্ছে। হঠাৎ সব কিছু বিচ্ছিরি রকমের এলোমেলো হয়ে গেলো।
ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে দুটি অন্নের যোগান দিতে মানুষ নামছে। হয়তো এদের অনেকেই জানে না নিজেদের ভবিষ্যত। মুদি দোকান আর ওষুধের দোকান সামগ্রী আনতে পারছে না, কারণ শহরের পাইকারি দোকানে কর্মচারি নেই। কেউ জীবাণুর ভয়ে তো কেউ মানুষ নামক জীবের ভয়ে পথ মাড়াচ্ছে না। তাই অত্যাবশ্যক সামগ্রী গ্রামে পৌঁছাতে পারছে না। বাজার নেই, তাই শাক-সব্জি নেই। সরকারি ব্যবস্থা নিয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে বরাবরের মতো, অর্ধেক পৃথিবীর মালিক হওয়ার নেশায় যারা বুঁদ তাদের কাছে কী আশা করা যায়।
প্রত্যন্ত গ্রামগুলো অনেকটা অতীতে ফিরে গেছে। ভাঁড়ার ঘর ক্রমশ খালি হচ্ছে। যারা মাঠ ছেড়ে পথে নেমেছিল তারা আবার মাঠেই নামছে। বাকিটা অনেকটা আমাদের গ্রামের মতই। বাজার নেই, শ্রমিক নেই, তাই খরার মাঠে শুকিয়ে যাচ্ছে অনেকের ফসল । আর চাবাগান, সে কোনদিন ভালো ছিল ! অনাহার অর্ধাহার সেখানের নৈমিত্তিক ব্যাপার। তার সঙ্গে যোগ হল ঘরে বসে হাহাকার।
আরেকটা দিক মানসিক পরিবর্তন। দিনরাত হাত পা পরিষ্কার রাখতে গিয়ে, মানুষের স্পর্শ থেকে সরে থাকতে থাকতে শুচিবাই, সন্দেহ সহ নানা ধরণের বাতিক ব্যাপক রূপ নিতে পারে। অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক, বিচ্ছিন্নতা, উদ্বেগ প্রতি মুহুর্তে মানুষকে আঘাত করছে। শিশু, কিশোর-কিশোরী ও বয়োজ্যেষ্ঠদের মানসিক যন্ত্রণা আরও ব্যাপক। হাইপোকন্ড্রিয়াক, অসিডি, সিডি, এফএনডি ইত্যাদি সমস্যা থাকা মানুষের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে, আর সামান্য মানসিক দুর্বলতা থাকা মানুষের নতুন উপসর্গ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এইসব মানসিক সমস্যাকে আমাদের শিক্ষিত সমাজও পাগলামি ভাবে। আর এর সুযোগ নিয়ে মুল্লা-তান্ত্রিক-বুজরুকি দলের বাড়াবাড়ি চুড়ান্ত রূপ নিতে পারে।
WhatsApp Image 2020-04-18 at 10.10.34 PM
ত্রাণ সংগ্রহ করতে ভিড় জমিয়েছেন লোক। একমাস আগেও এদের অনেকেই সচ্ছ্বল ছিল। ছবি: সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
আমি ২০০০ সালে বলেছিলাম, নতুন সহস্রাব্দ শুধু ক্যালেন্ডার বদল নয়, বিশ্বজুড়ে এক আমূল পরিবর্তন হবে, যা আমাদের প্রত্যন্ত বরাক উপত্যকায়ও আছড়ে পড়বে, এই পরিবর্তন সম্পন্ন হবে ২০২০ সালে। সম্ভবত ২০০২ সালে লক্ষ্মীপুরে এক সরকারি সভায় এই কথা বলেছিলাম গুণীজনদের সামনে বিশদ ভাবে। বয়স কম ছিল, তাই বলতে পারতাম। ২০১৭ সালে ফেসবুকে একথা আবার বলেছিলাম, কেন যেন মনে হয় এই কথা কৈশোরে দেখা আকাশ কুসুম নয়। ২০১৯ সালে আবার এই কথা বলতে চাইছিলাম, লোকে হাসবে ভেবে আর লিখিনি । এই অনুমান করতে কোনও বিশেষ শক্তির দরকার নেই। মানুষের সামুহিক গতিবিধি লক্ষ করে সহজেই এই কথাটা অনুমান করে বলা যায়। আরও একটা ব্যাপার আমি প্রায়ই আমার ঘনিষ্টমহলে বলতাম – এমন এক দিন আসবে যখন রাস্তায় শুধু ডেলিভারি ভ্যান, আম্বুলেন্স, পুলিশ ইত্যাদি চলবে। এই কথা বলেছিলাম বিজ্ঞানের অগ্রগতি লক্ষ করে। কিন্তু এভাবে জোর করে এই পরিস্থিতি এত তাড়াতাড়ি নিজের জায়গা করে নেবে তা ভাবতেও পারিনি।
করোনা বড় বেদনাদায়ক। কতটুক তা একজন আক্রান্ত ব্যক্তিও ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেন না। সবচেয়ে বড় আঘাত তখনই লাগবে যখন আক্রান্ত ব্যক্তি একলা বসে কিছু স্মৃতি রোমন্থন করবেন, ‘কোথায় গিয়ে এই রোগটা নিজের শরীরে বয়ে আনলাম, তারপর কার কার শরীরের সংস্পর্শে এলাম।’ এই চিন্তাটাই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেবে, ‘আমার জন্য আর কে কে এই ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার হল !’ তাই সব গোড়ামি ছেড়ে ঘরে থাকাটাই শ্রেয়। নিজের জন্য না হলেও আপনজনের কথা ভেবেই ঘরে থাকতে হবে। এই দুঃসময়ে মানুষের ঘরে থাকা নিশ্চিত করাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ মানুষ এসবে অভ্যস্ত নয়। ঘরের বাইরে যা যা নিয়ম মেনে চলা বা ঘরে ফিরে নিজের পরিবারকে বাঁচাতে যা যা করণীয়, কেউ তা করবে না। কারণ বেশির ভাগ মানুষ এসবকে হাস্যকর ভাবে।
আমদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় জড়িত ব্যক্তিরাও এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত নয়। এখন প্রয়োজন সব বিলাসিতা ত্যাগ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে খরচ করা। ক্ষুধার্তদের মুখে অন্নের যোগান দেওয়া জরুরি। ঘরে বসেই যেন রোজগার করা যায়, অর্থব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এই পরিকাঠামো তৈরিতে জোর দিতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীরা যেন মানসিকভাবে সুস্থ থাকে আর তাদের শিক্ষা যেন ব্যাহত না হয় সে ব্যবস্থা করতে যা খরচ হয়, করতে হবে। এই সময় আণবিক বোমা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা গেলে তাও করতে হবে। সামরিক শক্তিকে অন্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে। যুদ্ধবিমান দিয়ে জীবাণু মারা যায় না, তাই বিজ্ঞানের ব্যবহার অন্যত্র করতে হবে। পুরো বিশ্বের মানুষকে অহিংস নীতি পালন আর সহজ জীবন যাপনের অভ্যাস করতে হবে। কারণ কথায় আছে, এক মাঘে শীত যায় না।

এই লেখাটি বরাক হিউম্যান রাইটস প্রটেকশন কমিটির ওয়েব সাইটে প্রকাশিত হয়েছিল ১৮ এপ্রিল, ২০২০ 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন