বুধবার, ৬ মে, ২০২০

করোনা, লক ডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি– ৪

করোনা, লক ডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি– ৪

সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
WhatsApp Image 2020-05-06 at 6.49.44 PM (1)
ম্যাজিক ড্রাইভারস এসোসিয়েশন তহবিল সংগ্রহ করে চালকদের পরিবারের কাছে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছিয়ে দিচ্ছে। ছবিঃ সাদিক মোহাম্মদ লস্কর।
অনেকটা পাল্টেছে পরিস্থিতি। করোনা যে আমাদের নিত্যশত্রু হয়েও নিত্যসঙ্গী হয়ে থাকবে আরো বহুদিন সেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। দেশে করোনা আক্রান্ত বা মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বাড়লেও জীবনের চাকা সচল করার চেষ্টা চলছে। এই অসময়ে মানুষের বদান্যতা ও মহানুভবতা ছিল লক্ষ করার মত। অনেক সমালোচনা সত্বেও বলতে হয় এই সময় কিছু সচ্ছল লোক যদি এগিয়ে না আসতেন তাহলে হয়তো উপোস করে মরতে হত অনেক মানুষকে। এখন অনেক নিঃস্ব পরিবার নাকি প্রার্থনা করছে যেন লকডাউন আরো দীর্ঘায়িত হয়। এদিকে পরিবারের মখে দুটি ভাত তুলে দিতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে এতদিনে তিলে তিলে গড়ে ওঠা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারগুলো। বছর পঁচিশের অবিবাহিত মেয়েদের বা জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারা বছর তিরিশের যুবকদের মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। পরিবারে অশান্তি দেখা দিয়েছে তাদের যারা সঠিকভাবে সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার শত চেষ্টার নিগড় ভেঙে বেরিয়ে যাচ্ছে পড়ুয়ারা।
সারা দিন কাজ করে শ’পাঁচেক রোজগার করে ব্যাগ ভরে নিয়ে আসা, বেসরকারি বিদ্যালয়ে সন্তানদের শিক্ষাদান, সম্মানের জীবনযাপন এই সব এখন আর সম্ভব নয়। ভাত আছে তো ডাল নেই, তেল নেই। গ্রামের কজন মানুষের মুরোদ আছে রোজ রোজ গাড়ি ভাড়া করার। যাত্রীবাহী গাড়িতে তিনজন যাত্রী নিয়ে সড়কে চলে বিকেলে কি পরিবারের মুখে ভাত দিতে পারবেন চালক? মিস্ত্রিরা এখন কাজ করতে পারেন ঠিকই। কিন্তু কতটুকু? ৬০০ টাকা দরে সিমেন্ট কিনে কজন বাড়ির কাজ করবেন এখন। সরকারি উন্নয়নমুলক কাজ প্রায় বন্ধ। তাও কম মানুষ লাগানোর ফরমান আছে। পান দোকান খুলেছে ঠিকই, কিন্তু দোকানির সদ্য স্পর্শ করা পান কিনে মুখে পুরে নির্ভয়ে চিবিয়ে নেবেন কজন? ক্ষৌরকর্মী এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতে পারেন। তা নিছক চুল ছাঁটানোর জন্য ঘরে বিপদ ডেকে আনবেন কজন? পার্লারের মহিলাটি বা ছোকরাটি তার সব আসবাব সঙ্গে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে পারবে? এমন আরো বহু পেশা আছে যা এখন আর ঠিক চলছে না। এই সব মানুষ হাত পাততে পারে না, তাকে দান করতেও কেমন কেমন লাগে।
REPORT THIS AD

অপ্রত্যাশিতভাবে লাভবান হয়েছেন একেবারে নিঃস্ব পরিবারগুলো। বলছি না যে রাতারাতি ধনী হয়ে গেছেন এরা। কিন্তু বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধর্না দিয়ে বাড়ি ফিরে আধপেটা থাকতে হচ্ছে না। বরং ত্রাণের ডাল-চাল বিক্রি করতেও পারছেন তারা। আর লাভবান হয়েছেন কৃষক। দুবারের অকাল বন্যায় ভাসিয়ে নেওয়ার পরও নদীর ধারে যারা তৃতীয়বার ফসল ফলিয়েছিলেন তারা লাভবান হয়েছেন। প্রথমটা একটু সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু বাইরের সব্জি না আসায় শেষমেষ অবশিষ্ট ফসল বিক্রি করেই পুষিয়ে নিয়েছেন তারা। ধান চাষ শুরু হতে এখনও বাকি। গালামাল, ওষুধ সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবসায়ীদের ফায়দা হয়েছে। তবে এই সব ফায়দা কচুপাতায় জলের মত সাময়িক। মিতব্যয়ী না হলে ঘোর অমাবস্যা অপেক্ষা করছে। নিম্নমধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেলে তার প্রভাব পড়বে উপরের মহলেও।
WhatsApp Image 2020-05-06 at 6.49.44 PM
বাজার শুরু হয়েছে। ক্রেতা বিক্রেতা বাজারে হাজির।  ছবিঃ সাদিক মোহাম্মদ লস্কর।
কৃষকদের আবার অনেক রকমফের আছে। যারা শুধু মরশুমে পরের ক্ষেতে চাষ করেন তাদের বছরের ভাত সঞ্চয়ে নেই। শুকনো মরশুমে শহরে বা গ্রামে জোগালির কাজ করে গতর খাটিয়ে পেট চলত তাদের। সব বন্ধ হয়ে গেছে। রেশনের চাল এসেছে, কিন্তু তা থেকেও নাকি এক কিলো করে বাট্টা দিতে হয় ডিলারকে। জিরো অ্যাকাউন্টের টাকা এসেছে ঠিকই। ছোট বাড়িটাতে কিছু সব্জি লাগাতে পারছেন না, কারণ এবারের রাস্তার কাজ করতে গিয়ে নিকাশি নালাটা বন্ধ করে দিয়েছেন মেম্বার। বাড়ির উঠোনে জল থৈ থৈ করবে আর কদিন পর। নদীর ধার ছাড়া বাকি জমিতে শুধু ধানই হয়। তাই যাদের নদীর ধারে জমি নেই তাদের তেল মশলা সব্জি কিনতে টান পড়ছে। সরকারের চোখ রাঙানোকে তুড়ি মেরে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হু হু করে।
দোকান খুলছে এবার, কিন্তু পালা করে। এতদিন পরে দোকান খুলে দেখা গেল কাপড়গুলোতে ইঁদুরের দল দুষ্টুমির কারুকার্য রেখে গেছে। প্রথমটা মাঝে মাঝে শাটার খুলে নাড়াচাড়া করেছিল কাপড় দোকানিরা। কিন্তু একবার খুলতে গিয়ে থানার দালালটা আড়চোখে চেয়েছিল মাত্র। মিনিট পাঁচেক পর দারোগাবাবু দলবল নিয়ে এসে সবার সামনে ঘাড় ধরে নিয়ে গেলেন একজনকে, মা-বোন সহ চোদ্দপুরুষ তুলে বিচ্ছিরি গালিগালাজ দিলেন, লকডাউনের আছিলায় লকআপে পুরে রাখলেন রাতভর, বাড়ির মানুষ এসে দারোগাবাবুকে খুশি করে সকালে তাকে উদ্ধার করলেন। এর পর আর দোকান খোলা হয়নি। এমন অনেক ঘটনা আছে। শাটারের ভিতর নষ্ট হয়েছে ব্যবসায়ীর মূলধন।
REPORT THIS AD

টিউশন, ছোটো ব্যবসা, বেসরকারি স্কুল বা বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করে সামান্য টাকা রোজগার করে নিজের পকেট মানি জোগাড় করে অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা। সাফল্যের পরিচিত গলিপথ ছেড়ে কখন স্বপ্নের বন্ধুর পথে পা রেখে হারিয়ে গেছে যারা তারা বাড়ির ঘ্যানঘ্যান থেকে একটু সরে থাকতে চায়। কিন্তু এখন মা-বাবার মুখের বিরক্তি, হতাশা কিংবা অন্যদের উপেক্ষা ঘরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে বার বার তার মাথায় এসে আঘাত হানে। ফ্যান, উড়নি আর গলার মধ্যে যেন কী একটা আকর্ষণ সে টের পায়। তবুও এসব সরিয়ে রাখে সে। নিজেকে সে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এই প্রবল আকর্ষণ-বিকর্ষণে তার মনটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়।
এখানকার বেশিরভাগ মানুষের কাছে আছে শিক্ষার দুটি উপায়। এক, সরকারি স্কুলে পাঠাও আর অনায়াসে শূন্য ঝুলি নিয়ে লাফ মেরে এগিয়ে যাও। দুই, বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করো, টাকা খরচ কর আর দুবেলা টিউশনিতে পাঠাও। সন্তানের পাশে দুঘন্টা বসার সময় ছিল না অভিভাবকের। এখন সময় থেকেও নেই। কারণ এ দায়িত্ব তো তাদের নয় বলেই ভাবেন তারা। তাই হোয়াটসআপ, জুম, টিভি, রেডিও কোনকিছুই শিক্ষার সেই ধারাকে ধরে রাখতে পারছে না। সরকারি স্কুলে দশ শতাংশ পড়ুয়া এই সুযোগ নিচ্ছে আর বেসরকারি স্কুলে তার বিপরীত পরিসংখ্যান। কিন্তু এই পড়ুয়ারাও অভিভাবকের আঙুল ছাড়িয়ে ইন্টারনেটের মোহময় বিচিত্র জগতে হাতড়ে বেড়াচ্ছে আর নানা নিষিদ্ধ ফলে হাত পড়ছে তার। ফলে ‘গুড মর্নিং’ ছাড়া আর কিছুই তার তরফ থেকে না পেয়ে হতাশ হয়ে যান শিক্ষক।
ভেবেছিলাম এইবার বোধ হয় নড়েচড়ে বসবে সরকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদিতে জোর দেবে। কিন্তু কই? সরকারি স্কুলের অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেসব নির্মাণ কাজ অর্ধসমাপ্ত ছিল সেগুলোও অনির্দিষ্ট কালের জন্য আটকে রইল। পড়ুয়াদের কষ্ট বেড়েই গেলো। ক্রমশ সংকোচিত হয়ে আসা কর্মসংস্থান হঠাৎ যেন চুপসে গেল। ফলে যুবসমাজের হতাশা মারাত্মক রূপ নিতে পারে। এখন সরকারের উচিত সামরিক বা অন্যান্য কম প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় কমিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ইত্যাদি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা। কর্পোরেটদের ঋণ মকুব না করে বাড়তি কর চাপানো। রাষ্ট্রসংঘ সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এখন বলিষ্ট ভুমিকা নিয়ে সীমাসুরক্ষার গুরুত্ব কমিয়ে আনতেও পারে। সংঘ, সংস্থা ইত্যাদির উচিত সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণে বাধ্য করা, অনুদানের অপেক্ষা না করে সম্পদের সদ্ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করা। এক কথায় সর্বস্তরের মানুষকে স্ফটিক স্বচ্ছ মন নিয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। দায়িত্বের বাইরে গিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দেওয়ার যে ট্রেন্ড চলছে তাকে উৎসাহিত করতে হবে। তবে শুধু পয়সা খরচ করলে চলবে না, প্রত্যেককেই নিজ নিজ দক্ষতা ও উদ্ভাবনী শক্তির প্রয়োগ করতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন