বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই, ২০২২

শিক্ষাব্যবস্থায় দোষারোপের প্রবণতা : অবসাদ ও আরোগ্য



 

শিক্ষাব্যবস্থায় দোষারোপের প্রবণতা : অবসাদের লক্ষণ? – ১

সাদিক মোহাম্মদ লস্কর

সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আসামের প্রায় সর্বত্র এক হতাশার পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে। আসামে অবস্থিত কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়গুলো এর ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম কেন এ কথায় পরে আসছি। তবে একথা সত্য যে হতাশাগ্রস্ত মানুষ পদে পদে ভুল করে এবং নিজের ব্যর্থতাকে আড়াল করার মতলবে ফন্দি ফিকির করে। হতাশার প্রতিক্রিয়া হিসেবে কেউ আত্মঘাতী পদক্ষেপ নেয় নয়তো সমস্ত দোষ জানা অজানা প্রতিপক্ষের উপর ন্যস্ত করে তৃপ্তি লাভের চেষ্টা করে। সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাও এই রোগে আক্রান্ত কি না তা খতিয়ে দেখার সময় হয়েছে। কারণ রোগ নির্ণয় না হলে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। শিক্ষাব্যবস্থা বলতে শুধু শিক্ষক নন, এ কথাও মনে রাখতে হবে।

চাইলেই একটি বিদ্যালয়ের শৈক্ষিক পরিবেশ ঠিক হয়ে যাবে না। কারণ এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে সমস্ত ব্যবস্থার মেরামত বকেয়া রেখে তা সম্ভব নয়। সমস্ত আসামের শিক্ষকদের উপর বেত্রাঘাত করলেও তা হবে না, বরং পরিস্থিতি আরও তলানিতে যাবে। শিক্ষাব্যবস্থার মূল কথাটাই হচ্ছে কম বলে বেশি করে দেখানো, আর রাজনীতির মূল কথাটা ঠিক এর উল্টো। অথচ শিক্ষা ব্যবস্থা রাজনীতির সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করতেই বাধ্য। কিন্তু ঠিক এর বিপরীত হওয়ার কথা ছিল। শিক্ষকদের ভৃত্য নয়, গুরু জ্ঞানে দেখা উচিত। যারা গুরুর মর্যাদা বোঝেন না, তাঁরা এই পদে বসেন বা বহাল থাকেন কী করে সেও এক আশ্চর্য।

আমাদের ব্যবস্থার সব চেয়ে বড় দোষ হল শিক্ষাকে এক অনুৎপাদনশীল ক্ষেত্র হিসেবে দেখা। শিক্ষাখাতে ব্যয়কে অনুদান হিসেবে দেখা হয়, বিনিয়োগ মনে করা হয় না। অথচ শিক্ষাই সব চেয়ে দীর্ঘমেয়াদী লাভজনক ক্ষেত্র। ২০১১-১২ সালে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দ ছিল জিডিপির ৩.৫ শতাংশ, ২০১৮ তে তা দাঁড়ায় ২.৮ শতাংশতে। যদিও বিত্তমন্ত্রী একে ৬ শতাংশতে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, তার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিনিয়োগ ছাড়া মুনাফা পাওয়ার জন্যে যে পরিশ্রমের দরকার তাও নজরে পড়ছে না। যা চলছে তা দোষারোপ করে তৃপ্তি লাভের চেষ্টা মাত্র।

শুধু কি উঁচুমানের পরিকাঠামোই উন্নতমানের শিক্ষা দিতে পারে? না, মোটেই নয়। এমন অনেক বিদ্যালয় রয়েছে যেখানে ল্যাবরেটরি রয়েছে, কিন্তু ধুলির আস্তরণ জমছে এগুলোর উপর। লাইব্রেরি রয়েছে, কিন্তু বইয়ের পাতা ছিঁড়ে বারোমজা খায় বাচ্চারা। বিজ্ঞান শিক্ষকরা জানেন না কী রয়েছে ল্যাবে। শিক্ষকরা একদিনও গ্রন্থাগারে গিয়ে বসেন না। কম্প্যুটার ল্যাবরেটরি রয়েছে, পাওয়ার ব্যাক-আপের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু ব্যবহারের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। বড়জোর স্কুলের অফিসের কাজ হয় এতে, পড়ুয়াদের কাজে লাগে না। খেলার সরঞ্জাম কেনা হয়, কিন্তু ধীরে ধীরে এগুলো উধাও হয়ে যায়। আরও কত কী?


          অভিভাবকরা আজকাল খুব বেশি সচেতন। এই ধরুন, সন্ধ্যেবেলায় তিনি বসে আছেন কোনও চা-দোকানে। দেশ-বিদেশের রাজনীতির পটপরিবর্তনে তাঁর যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে তিনি এলেন স্থানীয় শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাসে নিজের কীর্তিকে অক্ষয় করে রাখার কাজে নিজেকে ন্যস্ত করতে। চায়ের কাপে তুফান তুলে, বিড়ির প্রান্তে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনী দিয়ে সজোরে চাপ দিয়ে ফুসফুসে ধোঁয়া ভর্তি করে এবার তাঁর সিদ্ধান্ত, ‘মাস্টার অখলে লুটি লাইতরা!’ অথচ নিজের সন্তানকে কার ভরসায় রেখে এসেছেন সে প্রশ্নের উত্তর তাঁর কাছে নেই।

          শিক্ষকদের কাছে আপনি শৈক্ষিক পরিবেশ উন্নয়নের প্রস্তাব নিয়ে যান, তাঁরা বলবেন হাজারো সমস্যার কথা। এই যেমন সরকার শিক্ষার প্রতি উদাসীন, শিক্ষাদান ছাড়াও নানা কাজে তাঁদের ব্যস্ত থাকতে হয়, অভিভাবকরা সচেতন নয়, বেসরকারি স্কুলে ভালো ছাত্র চলে যায় ইত্যাদি। এই যখন আপনি কথা বলছেন তখন হয়তো তিনি স্টাফ রুমে বসে, হয়তো সামনের টেবিলটা থেকে সবেমাত্র চরণযুগল নামিয়েছেন, হয়তো সহকর্মীর সঙ্গে বর্ধিত বেতনের অঙ্ক কষছিলেন, আর তখন হয়তো তাঁর ক্লাসের পড়ুয়ারা স্কুল চত্বর ছেড়ে দোকানে আড্ডা মারছে।

          সরকারকে প্রশ্ন করতেই হয় না। স্বতঃস্ফুর্ত জবাব আসে, আমরা তো টাকা দিচ্ছি, শিক্ষকরা পড়ায় না। কয়দিন খোঁজ চলে ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের ধরার। কিন্তু জোঁক কি আর জাল দিয়ে ধরা যায়? ধরা পড়ে বেচারা মাছ আর কাঁকড়াই। তারপর ধীরে ধীরে সরকারের কাজের পাহাড়ের নিচে শিক্ষা নামক ‘অদরকারি’ ব্যাপারটা চাপা পড়ে যায়।

          শিক্ষা ব্যবস্থায় এই তিনটি ছাড়াও রয়েছে সমাজ নামক এক রহস্যময় প্রতিষ্ঠান। এর প্রতিনিধিরূপে নিযুক্ত হয় আরও রহস্যময় পরিচালন কমিটি। ‘নয়া অখতো নয় আনা, পুন্না অইলে ছয় আনা’—এদের কেউ কেউ বিপ্লব ঘটানোর সংকল্প নিয়ে হম্বি-তম্বি করে পরে মুখ থুবড়ে পড়ে যান। সমাজ থেকেই আরেকটি প্রতিপক্ষ তৈরি করা কোনও ব্যাপারই নয়। মৌচাকে ঢিল মারবেন আর বহাল তবিয়তে ফিরে আসবেন, সে কি আর হয়? সমাজের এক প্রভাবশালী অংশ যখন সমাজের কাজে বাধা দেয় তখন এই উৎসাহে ভাটা পড়ে যায়। অন্তত যখন তাঁরা বুঝতে পারেন যে আসলে তাদের কোনও ক্ষমতাই নেই — ঢাল নাই, তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার তাঁরা—তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হয় তাঁদের। আর যারা গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে দিতে পারেন তাঁদের কথা বলা বাহুল্য।