অভিভাবকদের বোঝাতে হবে যে স্কুল কোনও যন্ত্র নয় যেখানে ঢুকেই তাঁর সন্তান সফল মানুষ হয়ে বের হবে। কাগজ-কলে যেমন একদিকে বাঁশ ঢুকলে আরেক দিকে কাগজ হয়ে বের হয়, বিদ্যালয় তেমন কোনো কল নয়, আর তাঁর সন্তানটিও কোনো কাঁচামাল নয়। সে একটা জীবন্ত মানুষ শিশু। সে অনেক কিছুই বোঝে, অনেক কারণেই তার মনে ঢেউ ওঠে, তার নিজস্ব চাওয়া পাওয়া আছে। কিন্তু তাই বলে সে সুবোধ শান্ত নিরীহ নয়। সে অনেক কথা লুকিয়ে রাখে, অনেক কথা বাড়িয়ে বলে। শিশু মনস্তত্বের পন্ডিতদেরও ভুল হয়ে যায়। কখন শাসন একটু বেশি হয়ে গেল, কোথায় একটু আস্কারা পেয়ে গেল, কোন শিশুর প্রশংসা দরকার, কাকে কী ভাষায় তিরস্কার করতে হয়, কীভাবে রাশ ধরতে হয়, কাকে টান দিতে হয়, কাকে ধাক্কা দিতে হয় ইত্যাদি।
অনেকের ধারণা, আমি যাচ্ছেতাই করি, কিন্তু আমার সন্তান হবে একান্ত সুবোধ। তিনি হয়তো ধনী হয়েছেন, তাই শিক্ষিত মানুষগুলোকে তাঁর মনে হয় মূর্খ। তাই দিনরাত শিশুদের সামনে শিক্ষকদের গালমন্দ করেন। এতে তিনি হয়তো পরিতৃপ্তি পেতে পারেন। কিন্তু তাঁর সন্তানও তো তাই শিখবে। তাই সন্তানের সামনে শিক্ষকের সমালোচনা করা বা হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা সন্তানটির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করার পক্ষে যথেষ্ট। অভিভাবক নিজেই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন দিনরাত, রাত বিরেতে ঘুরঘুর করবেন কাজে অকাজে, বাড়িতে রোজ দিন আড্ডা জমাবেন, উপদ্রব করবেন আর সন্তানটি সারাদিন ভালো হয়েই চলবে — তা কি সব সময় হয়?
বেসরকারি বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের অভিভাবকদের ধারণা, 'আমি টাকা দিচ্ছি আর কী করব।' সরকারি বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও ধারণা প্রায় একই — 'মোটা অংকের মাইনে দেয় সরকার, আমি কেন খেয়াল রাখব?' আসলে অভিভাবকত্ব তো শিখতে হয়। বেশিরভাগ মা-বাবা যে অভিভাবকত্ব শিখতে আগ্রহী নন তা বোঝা যায় যখন অভিভাবক-শিক্ষক বৈঠক হয়, আর উপস্থিতি হয় ১০ শতাংশের মতো। উপস্থিত অভিভাবকদের মধ্যে ৮০ শতাংশ নিরব থাকেন, আর ১৫ শতাংশ শিক্ষকদের শিক্ষা দেওয়ার মতলবে কুণ্ডলী পাকানোর চেষ্টা করেন, ৫ শতাংশ সহযোগিতার মাধ্যমে পরিবেশ পরিবর্তনের ব্যর্থ চেষ্টা করেন।
নিয়ম মতে শিক্ষক-অবিভাবক সমিতি থাকার কথা। বেশীরভাগ বিদ্যালয়ে তা নেই, থাকলেও তা নাম মাত্র। আসলে বেশিরভাগ মানুষ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ফল লাভ করতে আগ্রহী। তাই ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতির প্রতি এক ধরণের অনীহা কাজ করে। সরকারি উদ্যোগের বিফলতার অন্যতম কারণ এটি। অভিভাবকদের অংশগ্রহণে প্রতি অনীহার পিছনে এই মানসিকতা অনেকটা দায়ি। এই সমিতি গঠন হওয়ার পর দু'একজন সদস্যই উপস্থিত থাকেন। বাকিরা বলেন, 'আপনারা যে সিদ্ধান্ত নেবেন তাতে আমাদের সম্মতি আছে।' এভাবে কিছুদিন পর সক্রিয় সদস্যরাও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।
পরিচালন সমিতির এক বড় অংশ জুড়ে থাকেন অভিভাবকরা। কিন্তু সেখানেও সেই একই অবস্থা। লক্ষ্য গুরুত্ব হারিয়ে উপলক্ষের দিকে পাল্লা ভারি হয়ে যায়। অর্থাৎ শিশুদের সার্বিক বিকাশ তাদের কাছে গৌণ, মুখ্য হয়ে পড়ে আর্থিক লেনদেন। এছাড়াও রয়েছে মাতৃগোঠ ইত্যাদি। কিন্তু কিছুই মূল উদ্দেশ্যকে সার্থক করতে পারে না। ব্যস্ততা এখন একটা সামাজিক ব্যাধি হয়ে গেছে। কেন যে অভিভাবকরা সন্তানের জন্য দু'দণ্ড সময় দেওয়ার বদলে একটু বেশি রোজগারের জন্য হন্যে হয়ে ঘোরেন তা বোঝা মুশকিল। অবশ্য প্রান্তিক মানুষ এসব সমিতিতে থাকেন না বললেই চলে। থাকলেও তাঁদের কিছু বলার বা করার থাকে না। তাঁদের ব্যস্ততাও অন্য ব্যাপার।
একবার এক অবিভাবককে জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনার ছেলের নাম বলুন।' প্রথমটায় একটু থতমত খেয়ে তারপর রাগে আগুন হয়ে ডাক দিলেন, 'হোই খানো যাস গিয়া খালি, অবায় আয়। তোর নাম কিতা খো।' আরেকবার এক ছাত্রের অভিভাবককে ডেকে জানানো হলো, তাঁর ছেলে প্রতিদিন স্কুলের কিছু না কিছু ভাঙচুর করে। তাঁর জবাব, 'অতার লাগি আবার ডাকা লাগেনি! সরকারে পইসা দের না নি! লই লাওনা আবার।' এ ধরনের অভিভাবকের কাছে সন্তানের শিক্ষা নিয়ে কী আর আলোচনা করা যায়! বেশিরভাগ অভিভাবক সন্তানের রোল নম্বর, ক্লাস ইত্যাদি জানেন না। এ বিষয়ে তার কী জ্ঞানাঅর্জন হল সেই আলোচনার চিন্তাই করা যায় না....