শনিবার, ৩০ মে, ২০২০

একটু নিজের কথাই বলি


একটু নিজের কথাই বলি

পৃথিবীতে আমার আসাটাই এক দুর্ঘটনা মাত্র। এক অপ্রত্যাশিত অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপার। আমার জন্যে কেউ বুক বেঁধে অপেক্ষা করেনি, বরং এক আপদ হিসেবে দেখাটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ আমার জন্মের সময় আমার দাদার বয়স ছিল মাত্র এক বছর। দাদার প্রাপ্য যত্ন, খাদ্য সবকিছুই আমার কারণে কমে গেল। বাঁশকান্দির অদুরে আলিপুরের বারোজ মেমোরিয়াল খ্রীস্টিয়ান হসপিটাল-এ আমার জন্ম। তারপর বড় হয়ে ওঠা বাঁশকান্দির পৈতৃক বাড়িটিতে। শিলচর-ইম্ফল জাতীয় সড়কটি আমাদের বাড়ি আর ১৯০৪ সালে স্থাপিত বাঁশকান্দি মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ের সীমারেখার মত মাঝখান দিয়ে গেছে।

আমার দান বা প্রাপ্তি কোনোটাই তেমন বড় নয়। এরকম মানুষের নিজের কথা লেখা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং হাস্যকর হতে পারে অনেকের কাছে। যদি তাই হয় তবে বুঝে নিতে হবে এই একটা কাজের কাজ হল আমার জীবনে, মানুষকে হাসানোর মত একটা বড় কাজ আমি করতে পেরেছি। কেউ আড়ালে বিদ্রূপ করলেও বুঝে নেব আমি কিছু কাজ করেছি। কেউ গালি দিলে বুঝব আমার শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন।

আমার জীবনে অনেক অনেক অভিজ্ঞতা আছে যা ঐতিহাসিক না হলেও কিছু ছবি তুলে ধরতে পারে। অনেক পারিপার্শ্বিক ব্যাপার হতে পারে সময়ের দলিল। আমার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পেশা, গ্রামের খুঁটিনাটি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তির পরিচয় পর্যায়ক্রমে তুলে ধরতে চাই। আশা করি এসব আমার আত্মপরিচয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আর শুধু শুধু বড়লোকের কথাই শুনব কেন? আমাদের জীবনেও তো অনেক উত্থান পতন আছে। আমাদেরও তো কিছু না বলা কথা আছে।

সমাজকে অনেক কিছুই দেয় একজন ব্যক্তি। তার লক্ষে অলক্ষে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে একজন সাধারণ ব্যক্তি পাওয়ার চাইতে দেয় বেশি। কারণ সে যে রোজগার করে তার একটা বড়ো অংশ সে এই সমাজের স্বার্থে ব্যয় করে। শুধু অর্থ নয়, তার সময়, শক্তি, সুখ, স্বাধীনতা অনেক কিছুই সে সমাজের জন্য বিসর্জন করে। সমাজ তার দায়িত্ব নেয় ঠিকই, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যায়। তো দাঁড়ালো এই যে প্রত্যেক ব্যক্তি সচেতনভাবে সমাজকে দেয় না। যারা দেয় না তারাই শীর্ষ আসনে বসে বাকিদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের দান প্রাপ্তির চাইতে অনেক কম। কিন্তু হিসেবের তালিকায় সেই নাম বড়ো হরফে লেখা থাকে। অথচ যারা নানা দ্বিধায় নিজের প্রাপ্তির রাশিকে বড়ো করতে পারে না তাদের দান তালিকায় বাদ পড়ে যায় এই বলে, যে ভিক্ষা তারা পেয়েছে এ তারই প্রতিদান মাত্র। অথচ মানুষ সমাজে বাস করে এই আশায় যে সমাজ তাকে সুরক্ষা দেবে প্রতি মুহুর্তে আর আপদকালে এই সুরক্ষা এতো বড়ো হবে যে তা দেখা যাবে সহজে। কিন্তু তা হয় না। হয় না বলেই বড়লোকদের বাড়ি ফেরাতে গিয়ে সারা দেশ তালা মারতে হল আর গরিব বাড়ি ফিরতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়ে, সরকারি লাঠির আঘাতে বা অনাহারে মারা পড়ে। বড়লোকের হাজার কোটি টাকার ঋণ মকুব হয় অনায়াসে আর কৃষক ঋণ খেলাপির দায়ে আত্মহত্যা করে।

কিন্তু তারপরেও তো ছোটলোকের লাশের উপর পা রেখে বেশিদিন চলতে পারে না বড়লোক। ছোটলোক ঘরে বসে মরলে বড়লোকের গাড়ি চলে না, বাড়ি চলে না, কল-কারখানা চলে না। পিরামিডের নিচের সারিতে যারা আছি আমরা আমাদের কথাও কিছু বলি। এখানে কাদা আছে, জোঁক কামড়ায়, নোংরা ধুলা শরীরে লাগে। কিন্তু এই সব এক একটা দলিল।



একটু নিজের কথাই বলি – ১

মার কাছে শুনলাম, জন্মের পর সুস্থই ছিলাম আমি। তিনি ঠাট্টা করে বলেন, বোধ হয় নজর লেগেছিল। চল্লিশ দিন পূর্ণ হতেই শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। স্থানীয় ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দেন। তখন যাতায়াত-যোগাযোগ ভালো ছিল না, শহরে নিতে গেলে হয়তো মৃত্যু হতে পারত। এমন সময় এগিয়ে এলেন খলিল মৌলবি নামের এক হোমিও চিকিৎসক। তাঁর ওষুধে অলৌকিক ভাবে সুস্থ হয়ে উঠলাম। সেই থেকে শরীরের সঙ্গে আমার যুদ্ধ লেগেই আছে, প্রত্যেক বারই আমার জিত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ মানেই হত বা আহত হওয়া। তাই প্রতিটি যুদ্ধে কম-বেশি আহত হয়েছি।

আব্বা আমাকে সাইকেলের বেবি সিটে বসিয়ে নিয়ে যেতেন আলিপুর। পুরাণ বাজার ছেড়েই রাস্তার দুপাশে ছিল বিস্তীর্ণ মাঠ – কখনও সবুজ, কখনও সোনালি। সেই নির্জন জায়গায় পৌঁছে তিনি কী বিড়বিড় করতেন আর ফুকফুক করে কাঁদতেন। চোখের জলের ছিটে এসে পড়ত আমার শরীরে। আমি বুঝতে পারতাম না, জিজ্ঞেস করে যে উত্তর পেতাম তা বোঝার বয়েস ছিল না আমার। বাড়িতে আমার বিছানা, থালা-বাটি সব আলাদা ছিল। খেলা-ধুলা করা নিষেধ ছিল। রোজ ডিম-মাংস খেতাম। একদিন সেই হাসপাতালে এলেন এক ডাক্তার – শাদা চামড়া, লম্বা শক্ত শরীর, বড় বড় আঙুল। বাবার কাছে জানলাম তাঁর নাম জীন বারোজ। আমাকে পরীক্ষা করে লাফ মেরে উঠে এত জোরে গর্জন করলেন যে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ‘লা মি না আ আ ....!’ এই আওয়াজে হাসপাতাল চত্বর যেন কেঁপে উঠল। ব্যস্ত হয়ে দরজার পাশে এসে হাজির হলেন ডা. লামিনা। তারপর দুজনে কী সব কথা হল। আবছা আবছা মনে পড়ে আব্বা আমাকে জড়িয়ে ধরে হেসেছিলেন তখন। বড় হয়ে আব্বার কাছে জানলাম ডা. জীন বারোজ সেদিন ডা. লামিনাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা কি টিবি রোগের লক্ষণ? চেহারা দেখে বোঝো না? এতদিন ধরে ছেলেটাকে কড়া ওষুধ দিয়েছ!!...’

এর পর সর্দি কাশি লেগেই থাকত। শীত এলে বাবা আমাকে এমনভাবে কাপড়ে মুড়ে দিতেন যে লোকে আমাকে এস্কিমো বলে বিদ্রূপ করত। নয় বছর বয়সে আমার হয়ে গেল এগজিমা। দুটি পা ফেঁটে পুঁজ রক্ত বের হত শীত এলে। অনেক ওষুধের পর একজন কবিরাজের চিকিৎসায় সেও কমল প্রায় তিন বছর পর। কিন্তু তখন এল শ্বাসকষ্ট। ফলে খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে খুব বাছ-বিচার চলত। মাস-দুমাস পর পর কী যন্ত্রণা। এরই মধ্যে একদিন ইসলামিক শিক্ষার এক প্রতিযোগিতামুলক পরীক্ষায় বসে ধরা পড়ল আমি চোখে কম দেখি। আমি দূরের বস্তু কম দেখতাম, কিন্তু ‘চালাকি’ করে কাউকে সেটা বুঝতে দিতাম না। ক্লাসে প্রথম বেঞ্চে বসতাম তাই কেউ বুঝতে পারত না। কিন্তু সেদিন হলের পেছন দিকে বসতে হয়েছিল। আমাদের মসজিদের ইমাম সেটা বুঝতে পেরে আমাকে আগে নিয়ে যান আর আমার বাড়িতে জানান। ধরা পড়ল আমার মায়োপিয়া ২.০। চশমা লাগাতে হল এগারো বছর বয়সে। আমার চশমা দেখে অনেকেই আঁতকে উঠতেন। ‘তুমি কি চশমা খুললে দেখতে পাও না?’ ‘কি হল চোখে?’ এ ধরণের অনেক প্রশ্ন আমাকে বড় কষ্ট দিত। এছাড়াও ঝগড়া হলে ছোট বড় অনেকেই গালি দিত ‘কানা’ বলে।

তেরো বছর বয়সে হাতে আসে এক যোগ ব্যায়ামের বই। সেটা পড়ে শুরু করে দিলাম যোগচর্চা। বদলে দিলাম খাদ্যাভ্যাস। শ্বাসকষ্ট থেকে রেহাই পেয়ে গেলাম এক বছরের মধ্যে। জীবনটাকে একটু ভোগ করার ইচ্ছে জাগল। কিন্তু প্রায়ই সর্দি-কাশি লেগেই থাকত। ডা. সুব্রত পাল প্রচুর অ্যান্টিবায়োটিক খাইয়েছেন। কমছে না দেখে আমি নিজে নিম-তুলসি-মধু মিশিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। অনেকটা কাজও হল। অনেক পরে জানলাম আমার এলার্জি আছে, ধুলো, বাক্সবন্দি কাপড়-কাগজ এসব নাকের কাছে গেলেই সমস্ত শ্বাসযন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে এখনও। ব্যাপারটা আগে জানলে হয়তো এত কষ্ট পেতে হত না।

ডা. চৌধুরীর কাছে আমার চোখের চিকিৎসা চলত। চশমার পাওয়ার বাড়তে থাকল। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বের হওয়ার কয়েকদিন আগে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে গিয়ে একটা ব্যাপার দেখে চিন্তায় পড়লাম। স্টাম্পগুলো মাঝখানে যেন ভাঙা মনে হল। এরপর যেদিকে তাকাই সব ভাঙা। বুঝলাম কিছু একটা সমস্যা আছে। পরদিন মনে হল সমস্যাটা নেই। আর কাউকে বললাম না। মাধ্যমিকের ফল যেদিন বের হল সেদিন আবার এই সমস্যা দেখা দিল। আমি জানতাম আমার রেজাল্ট কী হবে। তাই স্কুলে না গিয়ে ওরিয়েন্টাল হলে সিনেমা দেখতে গেলাম। দেখলাম পর্দাটা যেন ভাঙা। বাম চোখের দৃষ্টিশক্তি তুলনামূলক ভালো ছিল। সেই চোখেই ভাঙা দেখছি। পরদিন ডা. চৌধুরির কাছে এলাম। কয়েকদিন পরীক্ষার পর তিনি বললেন, রেটিনাল ডিটাচমেন্ট হয়েছে বাম চোখে। অপারেশন করতে হবে। যেতে হবে দূর মাদ্রাজে অবস্থিত শঙ্কর নেত্রালয়াতে। মাথায় যেন বাজ পড়ল সবার। কোন কলেজে কী বিষয় নিয়ে ভর্তি হবো এই পরিকল্পল্পনা নিয়ে সবাই যখন মশগুল, সবাই যখন আমাকে আর আব্বাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে সায়েন্স পড়লে ছেলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে, ঠিক তখনই ডাক্তার বললেন আমার পক্ষে পড়াশোনা আর হবেই না।

মাদ্রাজ যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হল। আব্বার বাইরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই কৃষ্ণপুরের আমার আত্মীয় তথা আব্বার সহকর্মী ফইজুল মামা আমাদের সঙ্গে যাবেন বলে স্থির হল। রেলের টিকিট বুক করা হল। ডাক্তারের পরামর্শে কমপ্লিট বেডরেস্ট। এরই মধ্যে ডাক্তার জানালেন একটা উপায় আছে, রোগ কমে যেতে পারে। আশায় বুক বেঁধে বিছানা পত্তর নিয়ে ভর্তি হলাম শিলচর মেডিকেল কলেজের আই অয়ার্ডে। আমার চোখ বেঁধে রেখে দেওয়া হল বিছানায়। দিনে কয়েকবার মেডিকেলের পড়ুয়ারা এসে বন্ধন খুলে ওটিতে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করত। মেয়েরাই বেশি উৎপাত করত। কেউ কেউ অযথা ঘেঁষাঘেঁষি করত, আমি বড়ই বিরক্তি বোধ করতাম। অবশ্য কারো কারো স্পর্শে জীবন ফিরে পেতাম। হিফজুর চাচা, আদিমা আন্টি দিনরাত লেগে থাকতেন। দশদিন এভাবে রাখার পর জানিয়ে দেওয়া হল মাদ্রাজ যেতেই হবে। পরে জানলাম এই দশদিন আমার চিকিৎসা হয়নি, ছাত্রছাত্রীদের গিনিপিগ ছিলাম আমি।

সেও এক অভিজ্ঞতা। চক্ষু বিভাগে তেমন গুরুতর রোগী নেই। বেশির ভাগ ছানির অপারেশন। করিমগঞ্জের এক রসিক বৃদ্ধ ছিলেন। জীবনের অপ্রাপ্তি নিয়ে এমন রসিকতা বোধ হয় সবাই করতে পারে না। আমাকে ডেকে বলতেন, ‘বুঝলায় নি নাতি, আমরার আর কদর নাই। সুন্দরী অখল তো পাল্লা, আমার বাড়ির এইনও আইন না। আইতাউ কিলা, পয়সা লাগে যেন।’ তিনি হাসপাতালের খাদ্য নিয়ে ব্যঙ্গ করতেন, ‘সরখারে সুয়াবি (সোয়াবিন) ইতা কিতা দি যেন বানাইল। অউ যেন গিলার রোজ। ভাতর লগে কামড় দিতে কচাৎ কচাৎ করে। গন লাগি গেছে।’ একদিন ভাত খেয়ে চরম তৃপ্তিতে ঘোষণা করলেন,’বুইচ্ছনিবা! আইজ এক কাম করছি। তলে নামিয়া হাগাই মরিছ লইয়া আইনছি। সরকারর ভাত আর সুয়াবি থালো লইয়া কান্দাবায় সাতগু হাগাই মরিছ থইছি। কামড়র লগে একোগু… হালার সুয়াবি… এবলাকু খাইতায় নায় আবার… ঝালে খালি ঠেলি ঠেলি হারার।‘ চক্ষু বিভাগের ওয়াশরুম তুলনামূলক ভাবে পরিষ্কার ছিল। আমার দাদা একদিন সেই ওয়াশরুম থেকে ফিরে বললেন, ‘এখানে পায়খানা করতে গেলে বমি করে ফিরতে হয়।’

তারপর একদিন অজানা দেশের উদ্দেশে পাড়ি দিলাম। বাস থেকে দুচোখ ভরে মেঘালয়ের পাহাড়, ঝরণা দেখলাম। ভাবলাম, আর এই চোখ দিয়ে এই রূপ দেখা হবে না বোধ হয়। গুয়াহাটি দেখে বিস্মিত হলাম, এতো লোক, এতো গাড়ি, অট্টালিকা। দিসপুরের যে আত্মীয়বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম তা এখন আর চেনাই যায় না। তখন ছিল মাটির গলিপথ, কচুরিপানায় ভরা বিস্তীর্ণ জলাভূমি। তারপর আরেক যাত্রা। এই প্রথম রেলভ্রমণ কোচিন এক্সপ্রেস চড়ে। গান গেয়ে, গানের দল গড়ে কামরায় কামরায় নিমন্ত্রণ খেয়ে কেটে গেল ৬০ ঘন্টা। প্লাটফর্ম পেরিয়ে মাদ্রাজ নগরী দেখে হতভম্ব। উঠলাম এস এম লজিং হাউসে। আব্বার কোনও অসুবিধে হল না। ইডলি, দোসা, সাম্বার গোগ্রাসে গিলছেন। আমি তো ফাঁপরে পড়লাম। কিছুই খেতে পারি না। পরিচয় হলো সোনাইর মিলন মামার সঙ্গে, সিনেমায় কাজ করতেন। আরো অনেকের সঙ্গে দেখা হল। এত আদর যত্ন সহযোগিতা মানুষ পরের জন্য করতেও পারে এই ব্যস্ত নগরিতে!

নেত্রালয়ে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করলাম। এক মহিলা জন্ম থেকে শুরু করে তখন পর্যন্ত অসুখ আর ওষুধের বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করলেন। অদ্ভুত সব যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা হল চোখ। ডাক্তার পি চাল্লা বললেন, দুচোখেই ডিটাচ হয়েছে কয়েক বছর আগে। বকাবকি করলেন, ‘দৃষ্টিশক্তি দ্রুত কমছে দেখেও তো ডাক্তারের বোঝা উচিত ছিল।’ যাই হোক বাম চোখ অপারেশন হল। ওটিতে যাওয়ার সময় গান গেয়ে গেয়ে ঢুকলাম। এক তামিল মহিলা হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন, কর্মীদের একজন আমার দিকে দেখিয়ে কী বলল মহিলাকে। বোধ হয় মহিলাকে সাহস দিল। আমি গর্বিত হয়ে একটু জোরে গান গাইলাম, ‘জিনা য়াহাঁ, মরনা য়াহাঁ’। বোধ হয় একটু আগে নেওয়া একটা ইঞ্জেকশনের প্রভাবও হতে পারে। তারপর একটা সেলাইন, ধীরে হাত থেকে শুরু করে মাথা পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে সব শেষ। জ্ঞান ফিরে আসার পর টের পেলাম আমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কী যন্ত্রণা আর অস্বস্তি। জানলাম আনেস্থেসিয়ার কারণে নাকি এসব হয়। তিনদিন পর চোখ খুলে দেওয়া হল। এলাম লজে, বেডরেস্ট। কিন্তু সেই ভাঙা দেখাটা থেকেই গেল। ডাক্তার বললেন, অপারেশন না হলে দৃষ্টিশক্তিই চলে যেত। আশ্বস্ত হলাম।

তারপর হল ডান চোখের অপারেশন। এই চোখটি এখন ভালো, কারণ বাম চোখে তো আমি ভাঙা দেখি। অপারেশন করলেন ডা. রবি। মনে পড়ে অপারেশন চলার সময় হঠাৎ আমার জ্ঞান ফিরে এসেছিল। সবাই চিৎকার করে আমাকে ঝাপটে ধরেছিল। বাড়ি ফিরে আসার পর কয়েক মাস পর আবার সমস্যা দেখা দিল। ডান চোখটাতে কিছু জ্বালা যন্ত্রণা হয়। গেলাম ডা. চৌধুরির কাছে। তিনি পরীক্ষা করে বললেন, বাকলটাতে চোখের পাতার ঘষা লেগে ক্ষত হয়ে গেছে। আবার গেলাম মাদ্রাজ। এবার বাকল রিমুভ করার জন্য ডান চোখে আবার অপারেশন করলেন ডা. মুনা পি ভেন্ডে। তিন মাস পর আবার যেতে বললেন। এরই মধ্যে সমস্যা দেখা দেওয়ায় ডা. চৌধুরির কাছে আবার গেলাম। তিনি শিলচর মেডিকেল কলেজের ওটিতে নিয়ে কীসব করলেন। পরে বললেন চোখের ক্ষতস্থানে একটা ফাঁক হয়ে গেছে, কিছুতেই জোড়া লাগছে না। নেত্রালয়াতে গেলে ডা. মুনা হেসে বললেন, এ আর জোড়া লাগবে না। প্লাস্টিক সার্জারি বা গ্যাস্প করা যেতে পারে। কিন্তু দরকার নেই। বছরে একবার পরীক্ষা করতে হবে। এবার এই চোখটাও আর ভালো রইল না। মনে হয় জ্ঞান ফিরে আসায় তড়িঘড়িতে কী একটা গণ্ডগোল হয়েছে, তবে সেটা আমার অনুমান মাত্র। এই কারণে লেন্স লাগানো সম্ভব নয়। লেজার তো আর সম্ভবই নয়।

একবার ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি ব্যায়াম করতে পারি? মাথা নেড়ে জানালেন পারব। আবার জিজ্ঞেস করলাম, খেলাঘুলা? পারবে। পড়াশোনা? তিনি একরকম রেগে গিয়ে বললেন, ‘ইউ ক্যান ডু এভরিথিং। হোয়াই আর ইউ আস্কিং? হু টল্ড ইউ দ্যাট?’ বললাম, আমাদের ওখানকার ডাক্তার বলেছেন। রেগে গিয়ে আমাকে ইংরাজিতে বললেন, ‘ওসব আজগুবি চিন্তা বন্ধ কর। কী হয়েছে তোমার যে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? তাহলে অপারেশন কেন করা হল?’ বহুদিন পর যেন মুক্তির স্বাদ পেলাম। এখনও আমি চলছি জীবনের জঙ্গল কেটে। এখনও আমি পড়ি, পড়াই, ব্যায়াম করি, কাজ করি। তবে জীবনের চাকাটাকে আগের গতি দিতে যেন দ্বিগুণ শক্তি দিতে হয়। কারণ দুর্ঘটনার পর গাড়ি মেরামত করে নিলেও আর আগের মত চলতে পারে না।


শনিবার, ২৩ মে, ২০২০

আতঙ্ক বড়ই সংক্রামক


আতঙ্ক বড়ই সংক্রামক

চোখের জলের হিন্দু-মুসলমান নেই।
দেশছাড়া হওয়ার চকচকে আতঙ্ক
গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।
তর্জনী আর কপোলে এখনও লেগে আছে
সদ্য মুছে ফেলা চোখের জলের অবশিষ্ট
আরেক ফোঁটা আগলে রেখেছে দু’চোখের পাতা।
সে চোখ তোমার , সে তোমার পরিচয়।
তোমার ধর্ম নেই, জাতি নেই।
ভগবান তোমার আবদার শুনে ভয় পায়,
সেও লাচার, ধনীর টাকা না পেলে সেও গৃহহীন হয়ে পড়ে।
আজকে যে ঘরে ঘুমাও তুমি,
যে জমির দখল রাখতে প্রতিবেশীর সাথে তোমার মোকদ্দমা চলে
সেই ঘর, সেই জমি, আগলে রাখা অলঙ্কার
নিমেষে নিঃশেষ হয়ে যাবার ভয় ঘুম ভাঙিয়ে দেয় তোমার।
যে মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা রেখেছো বিশ বছর মেয়াদে।
একদিন সেই কচি মেয়েটার জরায়ুর রক্তে
রাজপথ সিক্ত হয়ে যাবে সেই আশঙ্কায় জড়িয়ে ধরো তাকে।
জোয়ান ছেলেটার হাতে বই দেখে আঁতকে ওঠো তুমি
না জানি কবে কার নজরে পড়ে যায়।
পুরনো বাক্সটাকে জায়গা বদলে রাখো রোজ
তার ভেতরে রাখা কাগজ যেন হরিণীর মাংস,
লুকিয়ে রাখবে না হাতের কাছে রাখবে।
আতঙ্ক বড়ই সঙ্ক্রামক তুমি জানো
তবুও পারো না আট বছরের শিশুর চোখকে ফাঁকি দিতে
তার বইয়ের পাতায় তোমার আতঙ্ক ঘুর্ণিঝড় তোলে।

০৮-০১-২০২০

পার্থিব শিল্প

।। সাদিক মোহাম্মদ লস্কর ।।

তোমাকে বুঝতে বোঝাতে শেষ হয়ে গেল দিন।
নিজেকে বোঝানোর চেষ্টায় আমি ক্লান্তিহীন।
সন্ধ্যা হয়ে এল -- 
সব পাখি ঘরে ফিরে --
তুমিও তাই।

আমি আছি তারার নিচে
ঘাসের বিছানায়।
আজও শেখা হল না সেই সহজ পার্থিব শিল্প।

২৪-০৫-২০১৩

শুক্রবার, ৮ মে, ২০২০

তুমি আর সে

তুমি আর সে

বলেছিলাম প্রেম আর জীবনকে আলাদা
                                করে রাখতে।
তুমি বললে তখন প্রেম মানেই জীবন,
                                জীবন মানেই প্রেম।
এখন অদাহ্য প্রেম গুটি গুটি পায়ে
                                 রান্নাঘরে এসে
চুলা আর কড়াইয়ের মাঝখানে খুব দ্রুত
                                  ঢুকে যায়।
কখনো কখনো দেখি উঁকি মারে
                                  সব্জির বস্তা থেকে।
মেঘামার্টের উজ্জ্বল তাকে তাকে প্রেম
                                  লাফালাফি করে।
তার আঙ্গুলে রেখে শিশুটি চুষে নেয়
                                  আমাদের প্রেম।
এখন তো প্রেম থাকে বাচ্চার স্কুলের গেটে,
                                  পিল আর তিলের তেলে।
বলিরেখা দেখা গেছে ভালোবাসার
                                   চিন্তাগ্রস্ত মুখে।
কিন্তু সে তো আজো মাঝরাতে দুজনের
                                   ঘুমন্ত শরীরে
নরম চাহনি মাখা দেহহীন দেহের
                                    বাতাস লাগিয়ে যায়।

বাঁশকান্দি
০৩/১২/২০১৯

মিনারের নিচে


মিনারের নিচে

তুমি কোথা আছো হে প্রিয়?
গ্রহ নয়, নক্ষত্রে নয়, অন্য কোথাও।
আমি বসে আছি এই পৃথিবীতে
যে আজ শেষপ্রায় মিনারের ভিড়ে।
আমি জানি সব বালি ও পাথর –
সমস্ত পৃথিবীই মিনার হয়ে যাবে।
তাই বলি এসো তুমিই এখানে।
আমাদের ঘর ভাঙে আমাদেরই নিরলস পরিশ্রমে।
ঘুমহীন নয়নে দিয়ে যাও শীতল পরশ।
তার পর শুরু হবে আমাদের নতুন সকাল।

বাঁশকান্দি
০৬-০৪-২০২০

বুধবার, ৬ মে, ২০২০

করোনা, লক ডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি– ৪

করোনা, লক ডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি– ৪

সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
WhatsApp Image 2020-05-06 at 6.49.44 PM (1)
ম্যাজিক ড্রাইভারস এসোসিয়েশন তহবিল সংগ্রহ করে চালকদের পরিবারের কাছে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছিয়ে দিচ্ছে। ছবিঃ সাদিক মোহাম্মদ লস্কর।
অনেকটা পাল্টেছে পরিস্থিতি। করোনা যে আমাদের নিত্যশত্রু হয়েও নিত্যসঙ্গী হয়ে থাকবে আরো বহুদিন সেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। দেশে করোনা আক্রান্ত বা মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বাড়লেও জীবনের চাকা সচল করার চেষ্টা চলছে। এই অসময়ে মানুষের বদান্যতা ও মহানুভবতা ছিল লক্ষ করার মত। অনেক সমালোচনা সত্বেও বলতে হয় এই সময় কিছু সচ্ছল লোক যদি এগিয়ে না আসতেন তাহলে হয়তো উপোস করে মরতে হত অনেক মানুষকে। এখন অনেক নিঃস্ব পরিবার নাকি প্রার্থনা করছে যেন লকডাউন আরো দীর্ঘায়িত হয়। এদিকে পরিবারের মখে দুটি ভাত তুলে দিতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে এতদিনে তিলে তিলে গড়ে ওঠা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারগুলো। বছর পঁচিশের অবিবাহিত মেয়েদের বা জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারা বছর তিরিশের যুবকদের মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। পরিবারে অশান্তি দেখা দিয়েছে তাদের যারা সঠিকভাবে সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার শত চেষ্টার নিগড় ভেঙে বেরিয়ে যাচ্ছে পড়ুয়ারা।
সারা দিন কাজ করে শ’পাঁচেক রোজগার করে ব্যাগ ভরে নিয়ে আসা, বেসরকারি বিদ্যালয়ে সন্তানদের শিক্ষাদান, সম্মানের জীবনযাপন এই সব এখন আর সম্ভব নয়। ভাত আছে তো ডাল নেই, তেল নেই। গ্রামের কজন মানুষের মুরোদ আছে রোজ রোজ গাড়ি ভাড়া করার। যাত্রীবাহী গাড়িতে তিনজন যাত্রী নিয়ে সড়কে চলে বিকেলে কি পরিবারের মুখে ভাত দিতে পারবেন চালক? মিস্ত্রিরা এখন কাজ করতে পারেন ঠিকই। কিন্তু কতটুকু? ৬০০ টাকা দরে সিমেন্ট কিনে কজন বাড়ির কাজ করবেন এখন। সরকারি উন্নয়নমুলক কাজ প্রায় বন্ধ। তাও কম মানুষ লাগানোর ফরমান আছে। পান দোকান খুলেছে ঠিকই, কিন্তু দোকানির সদ্য স্পর্শ করা পান কিনে মুখে পুরে নির্ভয়ে চিবিয়ে নেবেন কজন? ক্ষৌরকর্মী এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতে পারেন। তা নিছক চুল ছাঁটানোর জন্য ঘরে বিপদ ডেকে আনবেন কজন? পার্লারের মহিলাটি বা ছোকরাটি তার সব আসবাব সঙ্গে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে পারবে? এমন আরো বহু পেশা আছে যা এখন আর ঠিক চলছে না। এই সব মানুষ হাত পাততে পারে না, তাকে দান করতেও কেমন কেমন লাগে।
REPORT THIS AD

অপ্রত্যাশিতভাবে লাভবান হয়েছেন একেবারে নিঃস্ব পরিবারগুলো। বলছি না যে রাতারাতি ধনী হয়ে গেছেন এরা। কিন্তু বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধর্না দিয়ে বাড়ি ফিরে আধপেটা থাকতে হচ্ছে না। বরং ত্রাণের ডাল-চাল বিক্রি করতেও পারছেন তারা। আর লাভবান হয়েছেন কৃষক। দুবারের অকাল বন্যায় ভাসিয়ে নেওয়ার পরও নদীর ধারে যারা তৃতীয়বার ফসল ফলিয়েছিলেন তারা লাভবান হয়েছেন। প্রথমটা একটু সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু বাইরের সব্জি না আসায় শেষমেষ অবশিষ্ট ফসল বিক্রি করেই পুষিয়ে নিয়েছেন তারা। ধান চাষ শুরু হতে এখনও বাকি। গালামাল, ওষুধ সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবসায়ীদের ফায়দা হয়েছে। তবে এই সব ফায়দা কচুপাতায় জলের মত সাময়িক। মিতব্যয়ী না হলে ঘোর অমাবস্যা অপেক্ষা করছে। নিম্নমধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেলে তার প্রভাব পড়বে উপরের মহলেও।
WhatsApp Image 2020-05-06 at 6.49.44 PM
বাজার শুরু হয়েছে। ক্রেতা বিক্রেতা বাজারে হাজির।  ছবিঃ সাদিক মোহাম্মদ লস্কর।
কৃষকদের আবার অনেক রকমফের আছে। যারা শুধু মরশুমে পরের ক্ষেতে চাষ করেন তাদের বছরের ভাত সঞ্চয়ে নেই। শুকনো মরশুমে শহরে বা গ্রামে জোগালির কাজ করে গতর খাটিয়ে পেট চলত তাদের। সব বন্ধ হয়ে গেছে। রেশনের চাল এসেছে, কিন্তু তা থেকেও নাকি এক কিলো করে বাট্টা দিতে হয় ডিলারকে। জিরো অ্যাকাউন্টের টাকা এসেছে ঠিকই। ছোট বাড়িটাতে কিছু সব্জি লাগাতে পারছেন না, কারণ এবারের রাস্তার কাজ করতে গিয়ে নিকাশি নালাটা বন্ধ করে দিয়েছেন মেম্বার। বাড়ির উঠোনে জল থৈ থৈ করবে আর কদিন পর। নদীর ধার ছাড়া বাকি জমিতে শুধু ধানই হয়। তাই যাদের নদীর ধারে জমি নেই তাদের তেল মশলা সব্জি কিনতে টান পড়ছে। সরকারের চোখ রাঙানোকে তুড়ি মেরে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হু হু করে।
দোকান খুলছে এবার, কিন্তু পালা করে। এতদিন পরে দোকান খুলে দেখা গেল কাপড়গুলোতে ইঁদুরের দল দুষ্টুমির কারুকার্য রেখে গেছে। প্রথমটা মাঝে মাঝে শাটার খুলে নাড়াচাড়া করেছিল কাপড় দোকানিরা। কিন্তু একবার খুলতে গিয়ে থানার দালালটা আড়চোখে চেয়েছিল মাত্র। মিনিট পাঁচেক পর দারোগাবাবু দলবল নিয়ে এসে সবার সামনে ঘাড় ধরে নিয়ে গেলেন একজনকে, মা-বোন সহ চোদ্দপুরুষ তুলে বিচ্ছিরি গালিগালাজ দিলেন, লকডাউনের আছিলায় লকআপে পুরে রাখলেন রাতভর, বাড়ির মানুষ এসে দারোগাবাবুকে খুশি করে সকালে তাকে উদ্ধার করলেন। এর পর আর দোকান খোলা হয়নি। এমন অনেক ঘটনা আছে। শাটারের ভিতর নষ্ট হয়েছে ব্যবসায়ীর মূলধন।
REPORT THIS AD

টিউশন, ছোটো ব্যবসা, বেসরকারি স্কুল বা বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করে সামান্য টাকা রোজগার করে নিজের পকেট মানি জোগাড় করে অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা। সাফল্যের পরিচিত গলিপথ ছেড়ে কখন স্বপ্নের বন্ধুর পথে পা রেখে হারিয়ে গেছে যারা তারা বাড়ির ঘ্যানঘ্যান থেকে একটু সরে থাকতে চায়। কিন্তু এখন মা-বাবার মুখের বিরক্তি, হতাশা কিংবা অন্যদের উপেক্ষা ঘরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে বার বার তার মাথায় এসে আঘাত হানে। ফ্যান, উড়নি আর গলার মধ্যে যেন কী একটা আকর্ষণ সে টের পায়। তবুও এসব সরিয়ে রাখে সে। নিজেকে সে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এই প্রবল আকর্ষণ-বিকর্ষণে তার মনটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়।
এখানকার বেশিরভাগ মানুষের কাছে আছে শিক্ষার দুটি উপায়। এক, সরকারি স্কুলে পাঠাও আর অনায়াসে শূন্য ঝুলি নিয়ে লাফ মেরে এগিয়ে যাও। দুই, বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করো, টাকা খরচ কর আর দুবেলা টিউশনিতে পাঠাও। সন্তানের পাশে দুঘন্টা বসার সময় ছিল না অভিভাবকের। এখন সময় থেকেও নেই। কারণ এ দায়িত্ব তো তাদের নয় বলেই ভাবেন তারা। তাই হোয়াটসআপ, জুম, টিভি, রেডিও কোনকিছুই শিক্ষার সেই ধারাকে ধরে রাখতে পারছে না। সরকারি স্কুলে দশ শতাংশ পড়ুয়া এই সুযোগ নিচ্ছে আর বেসরকারি স্কুলে তার বিপরীত পরিসংখ্যান। কিন্তু এই পড়ুয়ারাও অভিভাবকের আঙুল ছাড়িয়ে ইন্টারনেটের মোহময় বিচিত্র জগতে হাতড়ে বেড়াচ্ছে আর নানা নিষিদ্ধ ফলে হাত পড়ছে তার। ফলে ‘গুড মর্নিং’ ছাড়া আর কিছুই তার তরফ থেকে না পেয়ে হতাশ হয়ে যান শিক্ষক।
ভেবেছিলাম এইবার বোধ হয় নড়েচড়ে বসবে সরকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদিতে জোর দেবে। কিন্তু কই? সরকারি স্কুলের অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেসব নির্মাণ কাজ অর্ধসমাপ্ত ছিল সেগুলোও অনির্দিষ্ট কালের জন্য আটকে রইল। পড়ুয়াদের কষ্ট বেড়েই গেলো। ক্রমশ সংকোচিত হয়ে আসা কর্মসংস্থান হঠাৎ যেন চুপসে গেল। ফলে যুবসমাজের হতাশা মারাত্মক রূপ নিতে পারে। এখন সরকারের উচিত সামরিক বা অন্যান্য কম প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় কমিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ইত্যাদি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা। কর্পোরেটদের ঋণ মকুব না করে বাড়তি কর চাপানো। রাষ্ট্রসংঘ সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এখন বলিষ্ট ভুমিকা নিয়ে সীমাসুরক্ষার গুরুত্ব কমিয়ে আনতেও পারে। সংঘ, সংস্থা ইত্যাদির উচিত সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণে বাধ্য করা, অনুদানের অপেক্ষা না করে সম্পদের সদ্ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করা। এক কথায় সর্বস্তরের মানুষকে স্ফটিক স্বচ্ছ মন নিয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। দায়িত্বের বাইরে গিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দেওয়ার যে ট্রেন্ড চলছে তাকে উৎসাহিত করতে হবে। তবে শুধু পয়সা খরচ করলে চলবে না, প্রত্যেককেই নিজ নিজ দক্ষতা ও উদ্ভাবনী শক্তির প্রয়োগ করতে হবে।

করোনা, লকডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি –৩

করোনা, লকডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি –৩


সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
জীবনকে ছন্দে ফেরানোর চেষ্টায়। নিজের ঘর মেরামতির উদ্যোগ। ছবিঃ সাদিক মোহাম্মদ লস্কর।
জীবনকে ছন্দে ফেরানোর চেষ্টায়। নিজের ঘর মেরামতির উদ্যোগ। ছবিঃ সাদিক মোহাম্মদ লস্কর।
REPORT THIS AD

মৃত্যুর স্রোতস্বিনীর ভয়ে জীবনের চাকা কতদিন থামিয়ে রাখা যায়! জীবন থেমে গেলেই তো মৃত্যু আসে সেই গতির ধারবাহিকতা বজায় রাখতে। তাই সেই নদীর ভয়ঙ্কর স্রোত উপেক্ষা করেও সেতু নির্মাণ করতে হয়। কিন্তু যখন প্লাবন আসে আমদের ঘরেও সেই স্রোত আর ঢেউ জোর ধাক্কা দিয়ে যায়। তখন সেতু নির্মাণের কথা কেউ ভাবতেও পারে না। সে চলে যাওয়ার সময় ছেড়ে যায় নোংরা কাদা আর আবর্জনার রাশি। সেই সব পরিষ্কার করে তবেই বাস্তুকারের মাথায় আসে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা। করোনার হানা পৃথিবীময় মহাপ্লাবনের মতোই; অনেকটা নুহ নবীর সময়কার প্লাবনের মতোই পৃথিবীময়।
কাদা আর আবর্জনার মধ্যেই আবার শুরু হয়েছে চলাচল। কিন্তু ধীর লয়ে। কিস্তি কিস্তি করে জীবনের পাপড়ি উন্মোচিত হচ্ছে। একটুকুন ছড়িয়ে দিলেই কোথা থেকে এসে ঝাপটা মেরে বসবে ভয়ঙ্কর মৃত্যু। এই তো আশেপাশেই সে ঘাপটি মেরে বসে আছে। তাই সাবধান; সাবধানের মার নেই। চিকিৎসা, অত্যাবশ্যক পণ্য, প্রশাসন ইত্যাদির সাথে এবার আংশিক মুক্ত হলো খাদ্য উৎপাদন ও বিক্রয় ব্যবস্থা, নির্মাণ, লরি মেরামত ইত্যাদি। সরকারি কার্যালয়ে পালা করে হাজিরা দেবেন কর্মচারীরা। জমায়েত বন্ধ থাকবে। শহরের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্নই থাকবে আরো বহুদিন।
আমাদের জীবন তো শহরমুখী হয়ে গেছিল। হঠাৎ করে সেই পথ বন্ধ হয়ে গেল। যাত্রীবাহী গাড়ি চালিয়ে যারা রোজগার করত তারা এখন আমাদের চোখের সামনেই কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। এরকম আরও অনেক কর্মক্ষেত্র অচল হয়ে পড়ছে। এদের জন্য জন্য বিকল্প কী? বরাক উপত্যকায় সেই অর্থে কৃষি নেই। এখানে সারা বছর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে না চাষির পেঠ ভরে না জমি মালিকের। ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যাওয়া কৃষিজমির মালিকরা এখন আর জমিদার নন। সরকারি উন্নয়ন কাগজে আর রাঘব বোয়ালদের পেটে। কোটি টাকার জলসিঞ্চন প্রকল্প থেকে দুই ফোঁটা জলের ছিটেও বের হয়না। মানুষের অনৈতিক দাবি মেটাতে টিলাগুলোর দেহ বিসর্জন হয়েছে জলাশয়ে। আর জলাশয় ভরে ঘর উঠেছে। তাই খাদ্য উৎপাদনের সব রাস্তাই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে প্রায় শূন্যহাতে ঘরে ফিরছে হায়দরাবাদ, বাঙ্গালোর, কাতার, দুবাই থেকে কাতারে কাতারে যুবকের দল। তাদের নিয়োগকারী উদ্যোগপতিদের অনেকেই এই বাড়তি বোঝা নানা অজুহাতে ঝেড়ে ফেলতে চাইছিল, এখন সে পথ পরিষ্কার হয়ে গেল। কম শ্রমিক দিয়ে বেশি মুনাফা অর্জনের চেষ্টাই করবে তারা। আসলে এদের তো কোনও লোকসান নেই, উদ্বৃত্ত মুনাফায় ঘাটতি হবে মাত্র। এই সুযোগে কোটি কোটি টাকার কর মকুব করার ধান্ধা করবে এরা। ফলে সস্তা শ্রমিকের ছড়াছড়ি হবে বিশ্বময়। আমাদের বরাকেও এর ঢেউ আছড়ে পড়বে।
WhatsApp Image 2020-04-21 at 11.26.54 AM
হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোর্স করে সুরাট গিয়ে চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল মুন বড়ভূইয়ার। এখন তো আর বসে থাকতে পারে না সে। ছবিঃ সাদিক মোহাম্মদ লস্কর।
এরকম একটা পরিস্থিতিতে আবার সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে পুনরুজ্জীবিত করা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু প্রয়োজন সব পারে। সময় বলে দেবে ঠিকই; কিন্তু সে অপেক্ষা না করে সময় থাকতে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষি, জলসেচ ইত্যদি বিভাগের যা গেছে তা নিয়ে আন্দোলন করার সময় এখন নয়। কিন্তু যা অবশিষ্ট আছে তা নিয়ে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায় সেই পন্থা ঠিক করতে হবে। এসব বিভাগের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের এখন কাগজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে মাঠে নামতে হবে। বর্ষার মরশুমে ধান সহ অন্যান্য শাকসব্জি কীভাবে ফলানো যায় সে চেষ্টা করতে হবে। বাঁধ নির্মাণের নামে রাস্তা নির্মাণ আর নয়। বরং যেখানে বাঁধ দরকার সেখানেই তা নির্মাণ করতে হবে। জবরদখল হওয়া জলাশয় মুক্ত করে মৎস্যচাষের উপযোগী করে তুলতে হবে। জল নিষ্কাশন ও সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে এমজিএনরেগার মাধ্যমে।
যারা কৃষির সঙ্গে মোটেই পরিচিত নয় তারা এখন এক বিপন্ন প্রজাতির মত। এদের কথা আলাদা করে ভাবতে হবে। স্বল্পকালীন ব্যবস্থাপনা হিসেবে এদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যবসা করার সুযোগ করে দিতে হবে। এছাড়াও এদের বড় অংশ যেহেতু শিক্ষিত তাই তাদের দক্ষ শ্রমিক, উদ্যোগী বা ব্যবস্থাপক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

পুর্ব প্রকাশিত

করোনা, লকডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি –২

করোনা, লকডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি –২


সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
WhatsApp Image 2020-04-18 at 12.49.43 AM
ক্ষুধার ধর্ম নেই। অ্যাকাউন্টের টাকা দিয়ে খাবার কিনে বাড়ি ফিরছেন ভিন ধর্মী দুই মহিলা। ছবি: সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
লকডাউনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হল। না, এখনও জয় করা গেল না এই অদৃশ্য শত্রুকে। তবে মনে হয় একটু দুর্বল হয়েছে। যদি হয়, তবে কারণটা কী তাও জানা গেল না। হয়তো আমাদের অপুষ্টি জর্জর শরীর ততটুকু অপারগ নয়। হয়তো দূষিত জল ও বাতাস সেবন করা এই শরীর দুর্বল জীবাণুকে প্রতিহত করে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। হয়তো চারদিকে জমে থাকা আবর্জনার ভিড় আর জীবাণুর আঁতুড়ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে অভ্যাস হয়ে গেছে অনেকের। হয়তো নানা ধরণের টিকা আমাদের শরীরে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করে রেখেছে। বা হয়তো অন্য কিছু। হয়তো আমরা এইভাবে বয়ে ফিরছি জীবাণুর দল। আর তার জেরে হয়তো ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে এখনও। হঠাৎ করে সব অহঙ্কার ধুলির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে হাহাকার আর আর্তনাদে ভরে যেতে পারে আমাদের চারপাশ। এই পরিস্থিতি যেন কখনও না আসে এই কামনা করি।
REPORT THIS AD

কিন্তু আমাদের চাওয়ায় কি সব ঠিক হয়ে যায়? আমরা চাইলেই কি ছেলেগুলো চক্কর মারা ছেড়ে দেবে? আমরা চাইলেই কি অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া ৫০০ টাকা তুলতে মহিলাদের ভিড় এক মিটার দুরত্ব বজায় রাখতে পারবে? আমরা চাইলেই কি মাছ বেচতে আসা লোকটার চারপাশের মানুষগুলোর রাক্ষুসে ভাব উবে যাবে? আমরা চাইলেই কি রেশনের দোকানের সামনের লক্ষণরেখার বাইরে বের হবে না সবজান্তা নির্ভীক লোকটার চরণযুগল? আমরা চাইলেই কি মৃত্যুঞ্জয়ী সংবাদকর্তার মুখ ভয় দেখানো ছেড়ে দেবে? আমরা চাইলেই কি সোশ্যাল মিডিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মহাজ্ঞানী লোকটা কালো দাঁতের ফাঁক দিয়ে দেয়ালে পিক ফেলা বন্ধ করে দেবে? না, হবে না। তাই ভয় হয়। কারণ আমি বা আমার মত অনেকেই জানি না আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটুকু। জানলেও বেপরোয়া হওয়ার সাহস রাখিনা, কারণ আমাদের বাড়িতে শিশু-বৃদ্ধ-অসুস্থ মানুষ আছেন। বাড়িতে না থাকলেও পাশের ঘরে আছেন।
পাঁচশ’ টাকার জন্যে বের হওয়া মহিলার কি মৃত্যুভয় নেই? আলবাৎ আছে। কিন্তু সন্তানের ফ্যাকাশে মুখ চোখের আড়াল করতেই হোক বা আশঙ্কায় টানটান নিজের চেহারাটা সন্তানের চোখের আড়াল করতেই হোক সে বেরিয়ে আসে। মন আনছান করে তার, গণ্ডির ভিতর থেকে তার পা ছিটকে বেরিয়ে আসে কখন সে টেরই পায় না। নির্ভীক লোকটা কি সত্যিই নির্ভীক? সে কি সত্যিই পরমেশ্বরের কাছে তার জীবনের ভার সঁপে দিয়েছে? এমনটা হলে তো সে বসে বসে ঘরের চাল ফেড়ে অন্ন বর্ষণের অপেক্ষায় থাকত। আসলে নিজের অসহায় অবস্থাকে সে নিজেই যেন উপহাস করে। যত্রতত্র পিক-থুথু ফেলা লোকটা কি সত্যিই আত্মবিশ্বাসী? না, ভার্চুয়াল জগতে নিজস্ব পরিসরকেই সে জগত বলে মনে করে। সেই একপেশে জ্ঞান আর বোকা বাক্সে ছড়ানো ঘৃণার জবাবেই সে থুথু ফেলে এখানে ওখানে। আর মাছের ক্রেতা-বিক্রেতা? মদ্রিখালে মাছ ধরতে গিয়ে জলদেবতা এই দুর্যোগে তাকে যে আইড় মাছ উপহার দিলেন তার ক্রেতা প্রত্যন্ত মদ্রিপার গ্রামে নেই, তাই সে বুকের দুরুদুরু চাপা দিতে দিতে বেরিয়ে আসে বড় দরকারি হাজার টাকার লোভে। আর ঠিক তখনই মৎস্যখেকো লোকগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারাও ঘরে আবদ্ধ পরিবারের সদস্যদের চমকে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারে না। বিনা কাজে ব্যাঙ্কে টাকা আসছে, তাই মাছ না খেয়ে মরতে যাবো কেন – এই ভাবনাও কাজ করে কিছুটা। আর দুরন্ত ছোকরাদের কী? চিরদিনই তো তাদের শাসন করতে গিয়ে নিজেদের সেই সময়টা ভুলে যায় বুড়োর দল। তাদের বুকের হাহাকারটা কে বোঝে! তাদের সঙ্গে কি দুমিনিট একান্তে আলাপ করে ঘরের লোক? অবশ্যই না। আর সংবাদ? যে কুকথার বাজার দীর্ঘদিনে গড়ে উঠেছে তা কি ভালো কথায় চলতে শুরু করবে হঠাৎ?
WhatsApp Image 2020-04-18 at 12.49.41 AM
চয়ন পাল শেষ পর্যন্ত কিছু সব্জি কিনে এনে ঘরের বারান্দায় বসে বিক্রি করছেন। ছবি: সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
বাড়িতে অকারণ উৎপাত শুরু করে দিয়েছে শিশুরা। ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যাওয়া বাড়িতে কি আর জায়গা আছে? ঘেন্না ধরে যায় তাদের। সকাল সকাল কাপড় পরে, চুল বেঁধে, পিঠে বইয়ের বোঝা নিয়ে যাওয়াতেও বোধ হয় পরিবর্তনের সুখ ছিল। একমাস হয়ে গেল বন্ধুদের দেখা নেই। ভাই-বোন-মা-বাবাতে সীমাবদ্ধ জীবন আর ভাল্লাগে না। কী হয়ে গেল হঠাৎ! বাবার চোখে চকচকে ভাবটা নেই, হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ঘোলা চোখে। মা যেন আগের মত নেই। সেই দুরত্ব কি সহ্য করা যায়? কবে খুলবে স্কুল, সেই প্রশ্নের জবাব কারো কাছে নেই। বাবা বোধ হয় ভিক্ষেও করে আজকাল – কারা এসে চাল-ডাল দিয়ে যায়, পয়সা নেয় না। এইসব হাজার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না বাচ্চারা। তাই তারা সব গণ্ডি ডিঙিয়ে বেরিয়ে পড়ে খেলার মাঠে। আর যারা পারে না তারা অকারণ উৎপাত করার অপরাধে মার খায় খিটখিটে মেজাজের অভিভাবকদের হাতে।
অনলাইন ক্লাস শুরু করেছে কিছু স্কুল। এতে পড়ুয়াদের সঙ্গে স্কুলের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন না হয়ে এক সূত্র রক্ষা হয়। এসব চলছে হোয়াটসঅ্যাপে নিতান্ত আনকোরা আন্দাজে। বেসরকারি স্কুলের এই উদ্যোগকে অনেকে সন্দেহের নজরে দেখছেন। অনেক অভিভাভক কর্মহীন হয়ে মোবাইলটি নিয়ে একটু ডুবে থাকবেন ভাবছেন, তো শিশুটি এসে সেই মোবাইলটি চেয়ে বসে, আর তখনই মেজাজ হারিয়ে বসেন অভিভাবক। শিক্ষকদের ভয়েস নোট পাঠিয়ে কড়া বার্তাও দেন অনেকে। অনেক বেসরকারি স্কুল সে চেষ্টাও করেনি। মন্দার বাজারে বেসরকারি স্কুলগুলো বেতন দেবে কী করে সেও এক সমস্যা। তাই অনলাইন ক্লাসের ঝামেলা বাড়ানোর ঝুঁকি নিতে চাইছেন না অনেকেই। সরকারি বিদ্যালয়ের চিত্র অন্যরকম। স্কুল খোলা থাকলেও যেখানে শিক্ষা দান বা গ্রহণে কোনও পক্ষেরই কোনও আগ্রহ থাকে না, সেখানে স্কুল বন্ধ থাকা অবস্থায় এই অখণ্ড অবসর বিনোদনের সুযোগ কে হাতছাড়া করে! ফলে সরকারের নির্দেশ যেমন দায়সারা, তেমনি শিক্ষকরাও যেনতেন প্রকারে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিতেই ব্যস্ত। পরিচালন সমিতি তো এসব বোঝেই না। যারা বোঝে তাদের হাতে তথ্য নেই। অ্যাডমিশন রেজিষ্টার নেই স্কুলে, থাকলেও সেখানে কোনও বর্ণনা নেই। আর অভিভাভক তো আর এসব সাত পাঁচে নেই। স্মার্ট ফোনই বা কজনের ঘরে আছে? সব গ্রামে ইন্টারনেট পরিষেবাও পৌঁছায়নি। তাই পড়াশোনা যে লাটে উঠেছে সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সব কিছু ছন্দে ফিরতে আরও কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।
সুখের শিখরে বসে ক্ষমতার অলিন্দে থাকা লোকগুলো মাটির খবর রাখে না। তারা ভাবে টাকা দিলাম, খাবার দিলাম, তার পরও ঘরে বসে থাকে না মূর্খের দল। পাঁচশ টাকায় কদিন যায়? শুধু কি খাবার? করোনা ছাড়া আর সব রোগ কি ত্রিভুবন ছেড়ে পালিয়ে গেছে? ওষুধ চাই, ঘর মেরামতের খরচ চাই, বস্ত্র চাই, মোবাইল রিচার্জ চাই, বই-খাতা চাই। পাঁচটা আলু, দুশ গ্রাম তেল, দু কিলো চাল, এক পোয়া ডাল দিয়ে ফটো তুলে যারা প্রচার করেন তারা বোঝেন না যে এই সামগ্রি দুবেলার ক্ষুধার যোগান নয়। এটা শেষ হওয়ার পরেই শুরু হয় জীবন সংগ্রাম। কারণ খাদ্যদ্রব্যের দাম এখন আকাশছোঁয়া। সরকার এসব নিয়ন্ত্রণে অপারগ।
WhatsApp Image 2020-04-18 at 12.49.42 AM
নিজের কাজ নেই। অভিজিৎ দেব বাবার পুরনো দোকানে আবার পসরা সাজানোর চেষ্টায়। শহর থেকে চড়া দামে পণ্য কেনা আর আনা বড়ো কঠিন। ছবি: সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
অনেকেই দেখেন অসহায় মানুষকে। অসহায় মানে বিধবা মহিলা, রুগ্ন-অক্ষম লোক, ভিক্ষাবৃত্তির উপর নির্ভরশীল পরিবার ইত্যাদি। কিন্তু এখন একটা নতুন শ্রেণী অসহায় শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। যাত্রীবাহী গাড়ির চালক, পান দোকানি, পুচকাওয়ালা, দোকানের কর্মচারি, রাজমিস্ত্রি – এদের চুলার খবর কে রাখে। লাইনে দাঁড়িয়ে হাত পেতে নিতে পারে না তারা। তাই এঘর ওঘর করে বেড়ায়। আগে জানলে হয়তো অন্য উপায় করে রাখত। প্রথমে হিমালয় পাহাড়ের আড়ালে, তারপর সাগরের ওপারে ছিল মানুষের দুঃখ। তাই দেখা গেল না, আর কেউ সতর্ক করেও দেয়নি।
এখন হবে কী? তাসের ঘরের মত নিচের তলা থেকে ধীরে ধীরে ধসে পড়বে আমাদের অর্থব্যবস্থা। অনেক কিছুই আর আগের মতো ফিরে আসতে পারবে না। বহুদিন রাস্তায় চলবে না যাত্রীবাহী গাড়ি। মানুষের স্বাভাবিক যাতায়াত ব্যাহত হয়ে পড়বে। ঘৃণা এই আছিলায় ছড়িয়ে পড়বে গ্রামে গঞ্জে। বহু মানুষ একঘরে হয়ে যাবেন সতর্কতার অজুহাতে। অস্পৃশ্যতা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এই সব কিছুর জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে সবাইকে। সরকার মানুষের কথা ভাবে না। তার ভিতর চলে রাজনীতির নানা জটিল অঙ্ক। তাই সচেতন মানুষকেই এ নিয়ে ভাবতে হবে, পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে। গণ হিস্টিরিয়া থেকে কীভাবে সমাজকে বাঁচাতে হবে তা ঠিক করতে হবে। নতুবা উন্মাদের দেশে পাগলা গারদের মতো বাস করতে হবে। এই বিপদে আন্তর্জাতিক সহায়তাও আশা করা যায় না।

পুর্ব প্রকাশিত

করোনা, লকডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি –০১

করোনা, লকডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি –০১


সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
WhatsApp Image 2020-04-18 at 7.12.40 AM
প্রত্যন্ত এলাকায় ইঁট ভাটির মালিকের দেওয়া ত্রাণসামগ্রী নিতে শ্রমিকদের ভিড়। ছবি: সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
চিনের উহান থেকে যে অদৃশ্য শত্রু মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করার দুরভিসন্ধি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলো সে আমাদের ঘরের কাছেই এসে হানা দিয়েছে। আচমকা এই আক্রমণে যখন সবাই সন্ত্রস্ত তখন কেউ কেউ এর প্রতিকারে হাস্যকর সমাধানও দিয়ে যাচ্ছিলেন। এরা মানুষ নিয়ে কারবার করেন। তাই করোনা পরবর্তী অবশিষ্ট পৃথিবী যদি হাতছাড়া হয়ে যায় এই ভয় মৃত্যুভয় থেকেও তাদের বেশি তাড়িত করে। আবার অনেকেই ভেবেছিলেন সব পীঠস্থান বন্ধ হয়ে গেছে, এবার বিজ্ঞানের জয় সুচিত হবে আর অন্ধকার দূর হবে। কিন্তু কই? করোনা মানুষকে চিনতেই পারলনা, মানুষ তার দুর্বলতা বুঝে নিল – এই ভেবে অবসর বিনোদনের ফাঁকে কারবার গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো একদল মানুষ। বিদ্বেষ ছড়ানো, মিথ্যা প্রচার, রাজনৈতিক প্রোপাগেণ্ডা ইত্যাদি শুরু হয়ে গেলো জোরকদমে। এদিকে মৃত্যুর সঙ্গে অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লড়ে যাচ্ছে কেউ, কেউ হেরে যাচ্ছে, কেউ জয়ী হয়ে ফিরছে ম্লানমুখে। আরেকটি দল মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে এক পরিচিত শত্রুর বিরুদ্ধে। সেই শত্রু হল ক্ষুধা। কিন্তু ক্ষুধায় যে মানুষ মরে এই সত্য এদের অনেকেই কোনোদিন কল্পনাও করেনি। সেই কল্পনার অতীত বাস্তব সামনে এসে দাঁড়ালো ভীষণ মূর্তি নিয়ে। অনেকের অনেক স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল – বিয়ে করবে, ছেলেমেয়ে মানুষ করবে, বার্ধক্য কাটবে নিশ্চিন্তে অথবা নিজের সঙ্গে আর দশটা পরিবার চলবে। সব কর্পুরের মত ধীরে ধীরে চোখের সামনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
দাস পদবির এক পরিবার আমাদের গ্রামে ভাড়া থাকে। বাড়ি অনেক দূর। স্বামী-স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে চার জনের পরিবার। কর্তা মিষ্টি দোকানের কর্মচারি। কোনোদিন কারো কাছে হাত পাততে হয়নি। লকডাউন ঘোষিত হলো, বাড়ি ফেরা হলো না। এখন কী অবস্থা সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের গ্রাম একধরণের স্যাটেলাইট ভিলেজ। বেশির ভাগ লোক খেত খামার ছেড়ে দিয়েছে সেই কবে। এই প্রজন্ম আর এসবে নেই। কেউ চাকরি করে, কারো পাইকারি ব্যবসা আছে। তারপর কেউ দালালি করে পেট চালায়, কেউ চা-পান বিক্রেতা, সব্জি বিক্রেতা, দোকানি, বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আর রয়েছেন দিনমজুর, চাষি, মৎস্যজীবী ইত্যাদি। গরিব পরিবারের ছেলেরা দেশে বিদেশে কষ্টার্জিত পয়সা দিয়ে বাড়ির চেহারা পাল্টাচ্ছে। হঠাৎ সব কিছু বিচ্ছিরি রকমের এলোমেলো হয়ে গেলো।
ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে দুটি অন্নের যোগান দিতে মানুষ নামছে। হয়তো এদের অনেকেই জানে না নিজেদের ভবিষ্যত। মুদি দোকান আর ওষুধের দোকান সামগ্রী আনতে পারছে না, কারণ শহরের পাইকারি দোকানে কর্মচারি নেই। কেউ জীবাণুর ভয়ে তো কেউ মানুষ নামক জীবের ভয়ে পথ মাড়াচ্ছে না। তাই অত্যাবশ্যক সামগ্রী গ্রামে পৌঁছাতে পারছে না। বাজার নেই, তাই শাক-সব্জি নেই। সরকারি ব্যবস্থা নিয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে বরাবরের মতো, অর্ধেক পৃথিবীর মালিক হওয়ার নেশায় যারা বুঁদ তাদের কাছে কী আশা করা যায়।
প্রত্যন্ত গ্রামগুলো অনেকটা অতীতে ফিরে গেছে। ভাঁড়ার ঘর ক্রমশ খালি হচ্ছে। যারা মাঠ ছেড়ে পথে নেমেছিল তারা আবার মাঠেই নামছে। বাকিটা অনেকটা আমাদের গ্রামের মতই। বাজার নেই, শ্রমিক নেই, তাই খরার মাঠে শুকিয়ে যাচ্ছে অনেকের ফসল । আর চাবাগান, সে কোনদিন ভালো ছিল ! অনাহার অর্ধাহার সেখানের নৈমিত্তিক ব্যাপার। তার সঙ্গে যোগ হল ঘরে বসে হাহাকার।
আরেকটা দিক মানসিক পরিবর্তন। দিনরাত হাত পা পরিষ্কার রাখতে গিয়ে, মানুষের স্পর্শ থেকে সরে থাকতে থাকতে শুচিবাই, সন্দেহ সহ নানা ধরণের বাতিক ব্যাপক রূপ নিতে পারে। অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক, বিচ্ছিন্নতা, উদ্বেগ প্রতি মুহুর্তে মানুষকে আঘাত করছে। শিশু, কিশোর-কিশোরী ও বয়োজ্যেষ্ঠদের মানসিক যন্ত্রণা আরও ব্যাপক। হাইপোকন্ড্রিয়াক, অসিডি, সিডি, এফএনডি ইত্যাদি সমস্যা থাকা মানুষের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে, আর সামান্য মানসিক দুর্বলতা থাকা মানুষের নতুন উপসর্গ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এইসব মানসিক সমস্যাকে আমাদের শিক্ষিত সমাজও পাগলামি ভাবে। আর এর সুযোগ নিয়ে মুল্লা-তান্ত্রিক-বুজরুকি দলের বাড়াবাড়ি চুড়ান্ত রূপ নিতে পারে।
WhatsApp Image 2020-04-18 at 10.10.34 PM
ত্রাণ সংগ্রহ করতে ভিড় জমিয়েছেন লোক। একমাস আগেও এদের অনেকেই সচ্ছ্বল ছিল। ছবি: সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
আমি ২০০০ সালে বলেছিলাম, নতুন সহস্রাব্দ শুধু ক্যালেন্ডার বদল নয়, বিশ্বজুড়ে এক আমূল পরিবর্তন হবে, যা আমাদের প্রত্যন্ত বরাক উপত্যকায়ও আছড়ে পড়বে, এই পরিবর্তন সম্পন্ন হবে ২০২০ সালে। সম্ভবত ২০০২ সালে লক্ষ্মীপুরে এক সরকারি সভায় এই কথা বলেছিলাম গুণীজনদের সামনে বিশদ ভাবে। বয়স কম ছিল, তাই বলতে পারতাম। ২০১৭ সালে ফেসবুকে একথা আবার বলেছিলাম, কেন যেন মনে হয় এই কথা কৈশোরে দেখা আকাশ কুসুম নয়। ২০১৯ সালে আবার এই কথা বলতে চাইছিলাম, লোকে হাসবে ভেবে আর লিখিনি । এই অনুমান করতে কোনও বিশেষ শক্তির দরকার নেই। মানুষের সামুহিক গতিবিধি লক্ষ করে সহজেই এই কথাটা অনুমান করে বলা যায়। আরও একটা ব্যাপার আমি প্রায়ই আমার ঘনিষ্টমহলে বলতাম – এমন এক দিন আসবে যখন রাস্তায় শুধু ডেলিভারি ভ্যান, আম্বুলেন্স, পুলিশ ইত্যাদি চলবে। এই কথা বলেছিলাম বিজ্ঞানের অগ্রগতি লক্ষ করে। কিন্তু এভাবে জোর করে এই পরিস্থিতি এত তাড়াতাড়ি নিজের জায়গা করে নেবে তা ভাবতেও পারিনি।
করোনা বড় বেদনাদায়ক। কতটুক তা একজন আক্রান্ত ব্যক্তিও ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেন না। সবচেয়ে বড় আঘাত তখনই লাগবে যখন আক্রান্ত ব্যক্তি একলা বসে কিছু স্মৃতি রোমন্থন করবেন, ‘কোথায় গিয়ে এই রোগটা নিজের শরীরে বয়ে আনলাম, তারপর কার কার শরীরের সংস্পর্শে এলাম।’ এই চিন্তাটাই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেবে, ‘আমার জন্য আর কে কে এই ভয়ানক পরিস্থিতির শিকার হল !’ তাই সব গোড়ামি ছেড়ে ঘরে থাকাটাই শ্রেয়। নিজের জন্য না হলেও আপনজনের কথা ভেবেই ঘরে থাকতে হবে। এই দুঃসময়ে মানুষের ঘরে থাকা নিশ্চিত করাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ মানুষ এসবে অভ্যস্ত নয়। ঘরের বাইরে যা যা নিয়ম মেনে চলা বা ঘরে ফিরে নিজের পরিবারকে বাঁচাতে যা যা করণীয়, কেউ তা করবে না। কারণ বেশির ভাগ মানুষ এসবকে হাস্যকর ভাবে।
আমদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় জড়িত ব্যক্তিরাও এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত নয়। এখন প্রয়োজন সব বিলাসিতা ত্যাগ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে খরচ করা। ক্ষুধার্তদের মুখে অন্নের যোগান দেওয়া জরুরি। ঘরে বসেই যেন রোজগার করা যায়, অর্থব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এই পরিকাঠামো তৈরিতে জোর দিতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীরা যেন মানসিকভাবে সুস্থ থাকে আর তাদের শিক্ষা যেন ব্যাহত না হয় সে ব্যবস্থা করতে যা খরচ হয়, করতে হবে। এই সময় আণবিক বোমা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা গেলে তাও করতে হবে। সামরিক শক্তিকে অন্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে। যুদ্ধবিমান দিয়ে জীবাণু মারা যায় না, তাই বিজ্ঞানের ব্যবহার অন্যত্র করতে হবে। পুরো বিশ্বের মানুষকে অহিংস নীতি পালন আর সহজ জীবন যাপনের অভ্যাস করতে হবে। কারণ কথায় আছে, এক মাঘে শীত যায় না।

এই লেখাটি বরাক হিউম্যান রাইটস প্রটেকশন কমিটির ওয়েব সাইটে প্রকাশিত হয়েছিল ১৮ এপ্রিল, ২০২০