মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০২০

একটু নিজের কথাই বলি -- ৩


।। সাদিক মোহাম্মদ লস্কর ।।

আব্বা
মা-বাবা সব জানে – শৈশবে এই বিশ্বাস থাকে আমাদের। কৈশোরের শুরুতে এই বিশ্বাস দুর্বল হতে থাকে, আর এক সময় মনে হয় মা-বাবা বোধ হয় কিচ্ছুই জানে না। যৌবনের শুরুতে এই অবিশ্বাসের ভিত্তিটাও দুর্বল হতে থাকে। মাঝ বয়সে এসে আবার মনে হয় মা-বাবা বোধ হয় সব জানে।এই ধারণা কম-বেশি সবার হয়। আমার ক্ষেত্রেও অনেকটা এরকমই। তবে আব্বা একেবারেই জানেন না, এই ধারণা বোধ হয় তেমন প্রশ্রয় পাওয়ার সুযোগ পায়নি। তিনি শিক্ষকই ছিলেন, আর কিছু না। কিন্তু এই একটি পেশায় এত বৈচিত্র আনা শুধু তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। শরীর ও মনে দৈবশক্তি না থাকলে বোধ হয় একজন পার্থিব মানুষের পক্ষে এতকিছু করা সম্ভব নয়।
সহপাঠীদের সঙ্গে আব্বা

উচ্চতর মাধ্যমিকের শংসাপত্র
আব্বার জন্ম হয় বাঁশকান্দি গ্রামেই। স্বনামধন্য শিক্ষক কামু মিয়া লস্কর ও আকলিমা বেগমের চতুর্থ সন্তান ও দ্বিতীয় ছেলে তিনি। নাম ময়ীনুল হক লস্কর। দলিল মতে তাঁর জন্ম ১৯৪৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। তবে একটু এদিক সেদিক হতেও পারে। অর্থাৎ ১৯৪০-৪২ সাল হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। আমার দাদাজি ৯৮ নম্বর বাঁশকান্দি এল পি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, সেখানেই তিনি পড়তেন। তারপর বাঁশকান্দি মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে। তখন সেখানে চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। এরপর পড়েছেন শিলচর সরকারি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। কনকপুরের মাফিক চৌধুরির বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা করেছেন কিছুদিন। তারপর চলে আসেন বোর্ডিংয়ে। তারপর সাইকেল কেনা হলে সাইকেল চড়ে কাশিপুর-বাদ্রিঘাট হয়ে শিলচর। তখনকার দিনে সাইকেল কেনা অনেক বড় ব্যাপার ছিল। আব্বা বলতেন, হাত একটু বাঁকা করে অনর্থক ক্রিং ক্রিং বেল বাজানোর এক আলাদা মজা ছিল। ১৯৬২ সালে উচ্চতর মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৪ সালে কাছাড় কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৬৭ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। আব্বা কী একটা বৃত্তি পেতেন, তা দিয়েই তাঁর পড়াশোনার খরচ চলত।

বিদায় বেলার কথা
স্নাতক হওয়ার পরই আব্বা চলে যান বাগপুর হাইস্কুলে। তাঁর মামা শিক্ষক মোজাহিদ আলি চৌধুরির ডাক এলো। প্রত্যন্ত বাগপুর এলাকায় স্থাপিত একটা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলতে হবে। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে কাজে যোগ দেন ১৯৬৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। প্রত্যন্ত হলেও প্রাচীন বসতি এই গ্রামে শিক্ষার সম্ভাবনা ছিল। তাই এই মিশন সফল করতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরে প্রধান শিক্ষক আলিম উদ্দিন চৌধুরির সঙ্গে সহকারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন সর্বশক্তি দিয়ে। প্রথমে বেতন ছিল ১৩০ টাকা। প্রায় ১৫ বছর পর ১৯৮২ সালের ১ জানুয়ারি স্কুলটি প্রাদেশিকরণ হয়। বেতন হল ৬২০ টাকা। সহকারি প্রধান শিক্ষক পদ সরকারি ভাবে পেলেন ১৯৮৬ সালের ৪ ডিসেম্বর। ১৯৯৯ সালের ৩০ জুন তিনি প্রধান শিক্ষক হন। ২০০৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অবসর গ্রহণ করেন। এই দিনটি যেন তাঁর কর্মজীবনের অন্তিম দিন ছিল। যেন শুধু স্কুল থেকে নয়, বিশ্বসংসারের সব বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে দিলেন। বেসরকারি স্কুলগুলোর তরফ থেকে লোক এলেন, টাকা-সম্মান সবকিছুর প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু তিনি সবিনয়ে সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। ফ্রি কোচিং ওয়ার্কশপও বন্ধ করে দিলেন। কেন যে তিনি সুস্থ থাকা সত্ত্বেও নিজেকে গুটিয়ে নিলেন তার কারণ খুঁজতে হলে তাঁর অবসর গ্রহণের সময়কার বিদায়ী ভাষণটা পড়তে হবে।

সাইকেল নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে
সংসারে অভাব অনটন লেগেই ছিল। তবুও পিছুটান ছিল না। বাগপুরের মানুষ তাঁদের অ্যাসিস্ট্যান্ট স্যারের সাইকেলের বেল শুনে ঘড়িতে দম দিতেন। আমার জ্যাঠু আইনুল হক লস্কর বাঁশকান্দি নেনা মিয়া উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষকতা করেছিলেন। পরে সমবায় বিভাগের পরিদর্শক পদে চাকরি পেয়ে চলে যান। তিনি আফসোস করতেন, ‘কতবার বললাম, আয় আমার বিভাগে। এল না। বললাম, ফিটনেস আছে, পুলিশে যা। গেল না। আজ এস পি হতে পারত।’ আব্বাকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘কথা ঠিক। কিন্তু আমি তো শিক্ষাব্রতী।’ সেই ব্রত নিয়ে ভেঞ্চার স্কুলে কাজ করেন। প্রাদেশিকীকরণ হওয়ার পরেই যে অভাব মিটে গিয়েছিল তা নয়। ১৯৭৬ সালে একটা সাইকেল কিনেছিলেন আর বোধ হয় কিনলেন ১৯৯৯ সালে। একটা ট্রানজিস্টার কেনার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু পারেননি। জমিজমা তো আর কেনাই হল না। ঘর বানালেন দীর্ঘ ২৫ বছরে (১৯৮৪-২০০৯)। কিন্তু মানুষ গড়ার স্বপ্ন এক মুহুর্তের জন্যেও ফিকে হয়ে যায় নি। অভাব অনটনের অন্য কারণও ছিল।
ছোটবেলায় দেখেছি আব্বার অনেক রকমের বন্ধু ছিলেন। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়তেন। নামাজ আদায় করে সব্জি-বাগান, গোয়ালঘর এইসব সামলে দাড়ি কাটতে বসে পড়তেন। তখনই এসে পড়তেন নানা বয়সের তাঁর বন্ধুরা। সৈয়দ চাচা, মকু ঠাকুর, মামুজি বলে ডাকতেন তাঁদের। এদের প্রায় সবাই ছিল দিনমজুর, কৃষক, অসহায় বৃদ্ধ ইত্যাদি। মনে হত যেন এরা এক একটা বিষয়ে বিশারদ। সব জরুরি পরামর্শ যেন তারাই দিতেন আব্বাকে। চুটিয়ে আড্ডা মেরে ভালো করে প্রাতরাশ করে ঢেঁকুর ছেড়ে বিদেয় নিতেন তাঁরা। এদের সঙ্গে পরামর্শ করাটা আব্বার আসল উদ্দেশ্য ছিল না। আসলে এদের পেটের (ক্ষুধার) খবর তিনি জানতেন। এছাড়াও অর্থ সাহায্য করার সময় যেন কেউ (এমনকি পরিবারের সদস্যরা) দেখতে না পায় সেই সুযোগটাও তো পাওয়া চাই। তাঁর মরদেহের পাশে বসে এক রিক্সাচালক হাউ হাউ করে কেঁদে বলে ফেলেছিলেন, ‘আমাকে সাহায্য করে বলতেন, কাউকে বলো না।’ এমন অনেক কিছুই আছে যা কেউ জানে না, আর কোনও দিন জানতেও পারবে না।

পুরষ্কার দিচ্ছেন ইমাদ উদ্দিন বুলবুল
প্রয়াত নবদ্বীপ সিংহ ও অন্যান্যরা
পুরষ্কার বিতরণে.ডা. কেনোয়ার
জয়পুরে সম্মানিত 
এইসব বদান্যতায় হয়তো তাঁর মন ভরেনি। বাগপুর হাইস্কুলে শিক্ষাদান করেও মন ভরেনি। তাই বৃহত্তর বাঁশকান্দি এলাকার শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের উপায় হিসেবে শুরু করলেন ফ্রি কোচিং ওয়ার্কশপ। ১৯৯৩ সালের ১ মে বাঁশকান্দি মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে শুরু করেন গরিব শিক্ষার্থীদের বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষাদান। পরে অভিভাবকদের দাবি মেনে সবার জন্যেই খুলে দেওয়া হয় এই মানুষ গড়ার কারখানা। ১৯৯৪ সালের ৩০ আগষ্ট লক্ষীপুর খণ্ড প্রাথমিক শিক্ষাধিকারিকের লিখিত অনুমতি নিতে হয়। দিনে অমানুষিক পরিশ্রম, রাত জেগে খাতা দেখা ইত্যাদি ছিল তাঁর রোজকার রুটিন। একটা মহল প্রবল বিরোধিতা শুরু করল। সরকারি শিক্ষক কর্তব্যে ফাঁকি দিয়ে টিউশনির বাজার খুলে তা রক্ষা ও বৃদ্ধির জন্যে নানা ফন্দি ফিকির করতেন, তাঁরা এবং আরও অনেকেই বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তিনি পেয়ে গেলেন এলাকার এক বিজ্ঞান স্নাতক সাজ উদ্দিন লস্করকে। সাধারণ পরিবার থেকে শিক্ষিত হওয়া এই নওজোয়ান কী বুঝে আব্বার উল্টো রথের সারথি হয়ে গেলেন। প্রতি বছর ঘটা করে অনুষ্ঠিত হত পুরস্কার বিতরণ। শুরু হল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। যোগ দিলেন ইমাথৈ সিংহ, বিজন চক্রবর্তী, হীরাকুমারী সহ আরেক দল। তাতেও তৃপ্তি না পেয়ে শুরু করলেন কামু মাস্টার স্মৃতি মেধা পুরস্কার। বাগপুর থেকে বরথল বাগান – নানা জায়গায় গিয়ে পরীক্ষা আয়োজন করা আর পুরস্কার বিতরণ। তারপর একে একে এলেন জাফরুল হাসান বড়ভুঁইয়া, আবুল হুসেন বড়ভুঁইয়া, আব্দুল মতিন লস্কর, মাহমুদ, কবির সহ অনেকেই। কয়েকটি গাড়ি ভাড়া করে দলবল নিয়ে যাওয়া হত। বছরে সামান্য টাকা ফি ধার্য করা হয়েছিল। কিন্তু বাধ্যতামুলক না হওয়ায় বেশিরভাগ অভিভাবক এই টাকা দিতেন না। ফলে এই বিরাট ব্যয়ভার বহন করতে হত তাঁকেই। এইসব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হতেন ডা. কুইন্টিন ডেলবার্ট কেনোয়ার, মন্ত্রী শহিদুল আলম চৌধুরি, উপায়ুক্ত পবন কুমার বড়ঠাকুর, বুদ্ধিজীবী অতীন দাশ, মকব্বির আলি বড়ভুঁইয়া, ইমাদ উদ্দিন বুলবুল, শিখা বড়ঠাকুর প্রমুখ। মন্ত্রী দীনেশ প্রসাদ গোয়ালা কথা দিয়েও একবার এলেন না, শুনেছি স্থানীয় কংগ্রেস কর্মীরা নাকি মানা করেছিলেন তাঁকে। অবসর গ্রহণের পর ফ্রি কোচিং ওয়ার্কশপ বন্ধ করে দেন আব্বা। কিন্তু কামু মাস্টার স্মৃতি মেধা পুরস্কার অতি গোপনে চালিয়ে গেছেন ২০১৩ সাল পর্যন্ত। তাঁর ফাইল ঘাটতে গিয়ে দেখলাম ১০০১ টাকা করে মেধাবি ছাত্র-ছাত্রীদের পুরস্কার দিতেন তিনি।

ধমকি ভরা চিঠি
আব্বা কর্তব্য সম্পাদন করতেন পঞ্চাশ আনা, ষোল আনায় তাঁর মনের ক্ষুধা মিটত না। অর্থাৎ বাগপুর হাইস্কুলে তিনি শুধু রুটিন মাফিক চলা এক শিক্ষকই ছিলেন না। দায়িত্বের বাইরে অনেক কাজ তিনি স্বেচ্ছায় করে যেতেন। খুব আরামে এসব কাজ করতে পারতেন, তা কিন্তু নয়। বাঁশকান্দি থেকে বাগপুরের রাস্তা খুব একটা মসৃণ ছিল না। এঁটেল মাটির রাস্তা, মাঝে সাইকেল চলার ‘লিক’, দুপাশে গভীর নালা। সেই রাস্তায় সাইকেল চালাতে গিয়ে কতবার পড়েছেন, কতবার গরু-মহিষের ধাক্কা খেয়ে নালায় পড়ে কাদা-জলে একাকার হয়েছেন। সহকর্মী ও ছাত্র-ছাত্রীরা সেকালে যে ফিরিস্তা ছিলেন, তা কিন্তু নয়। অনেকবার অনেক কিছু মোকাবেলা করতে হয়েছে তাঁকে। বাগপুর হাইস্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক শুক্কুর আহমেদ বড়ভুঁইয়া এক সভায় বলেছেন, ‘একদিন গরমে অতিষ্ট হয়ে শিক্ষকরা ছুটির আবেদন করলাম। গরম আবার কী – এই বলে চক-ডাস্টার নিয়ে মইন স্যার ক্লাসের দিকে রওনা হয়ে গেলেন। এই প্রৌঢ়ের মনের জোর দেখে লজ্জিত হয়ে তাঁর আগে গিয়ে ক্লাসে পৌঁছলাম।’ হয়তো তিনি নিজের শিক্ষক হিসেবে সমীহ করেছেন; সবাই তো আর করত না। এরকম কোনও এক কারণে তাঁর কাছে আসে এক বেনামি ধমকি ভরা চিঠি। সামলে রেখেছিলেন, এই সেদিন পেয়ে গেলাম সেই চিঠি। এমন আরও কত প্রতিবন্ধকতা ছিল।

আব্বা একজন খুব ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। কৈশোরে যৌবনে অনেক টুর্নামেন্টে খেলেছেন, জেলাস্তরের টুর্নামেন্ট আয়োজনও করেছেন। তাছাড়াও কাবাডি খেলায়ও তাঁর নাম ছিল এলাকায়। তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধু রিয়াজুল হক লস্কর (রিয়াজুল দারোগা), আফতাব আহমেদ (আতাই) প্রমুখ অগ্রজ অনুজ অনেকেই ছিলেন এই খেলার সাথি। সেই কারণেই বোধ হয় সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। সাংস্কৃতিক জগতেও তাঁর কর্মকাণ্ড ছিল। যাত্রা-পালা, নাটক আয়োজন ও অভিনয় করতেন। বিশেষ করে ঐতিহাসিক নাটক বা পাশ্চাত্যের মাহাকাব্যের বঙ্গানুবাদ এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এ ব্যাপারে অবশ্য তাঁর দাদা আয়ীনুল হক লস্কর নেতৃত্ব দিতেন। একটা বড়সড় দল গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু গ্রামের ধর্মীয় ও সামাজিক পরিবেশ দ্রুত পরিবর্তন হওয়ায় এসব থেমে যায় একসময়।

আব্বা ,আমরা ও এক তুতোভাই
মেয়ের কাছে লেখা চিঠি
আমরা ভাই-বোন একটু দেরিতে ৬ টা নাগাদ ঘুম থেকে উঠতাম। আমাদের প্রাতরাশ হয়ে গেলে পড়ানো শুরু করতেন আব্বা। ততক্ষণে তাঁর প্রথম সারির বন্ধুরা বিদেয় নিয়ে নিয়েছেন। ফজরের নামাজের সময় দেখা করে নিতেন তাঁর প্রায় সমবয়েসী বন্ধু রিয়াজুল হক লস্কর (দারোগা), মশরফ আলি বড়ভুঁইয়া (ব্যবসায়ী), সাজ্জাদুর বড়ভুঁইয়া (সইজ্জা পাটোয়ারি) সহ গ্রামের তখনকার মুরব্বিদের সঙ্গে।  তখন সাড়ে ১০ টায় স্কুলের ঘন্টি বাজত। ৯ টা নাগাদ আমাদের শিক্ষাদান শেষ করে স্নান করাতেন। গরমের দিনে আমাদের স্নান করাতে নিয়ে যেতেন বাঁশকান্দি আনুয়ায়। আনুয়ার ফটিক স্বচ্ছ জলে সাঁতার দেওয়া, হাঁস আর পরিযায়ী পাখির লীলা, ঊর্মিমালায় সকালের রৌদ্রের বিচ্ছুরণ, হাঁটুজলে বালির উপর মাছের ঘোরাঘুরি, দুরের ঘাটে ধোপার কাপড় আছাড় মারার অনেক পর আওয়াজ শোনার কারণ এইসব দেখানো আর শেখানো ছিল তাঁর আনুষঙ্গিক কাজ। সন্ধ্যার পর থেকে রাত নটা অবধি আরেক দফা পড়াশোনা। সন্ধেবেলা মাও কিছু পড়ানোর সময় পেতেন। ১৯৮৫ সালে আমাদের প্রতিবেশির সঙ্গে এক ছোটখাটো যুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মামলা মোকদ্দমা ছাড়াও এতদিনের সুহৃদ বা বন্ধুদের একাংশের অপর পক্ষ অবলম্বন বা নেতিবাচক ভুমিকা দেখে বেশ আহত হয়েছিলেন মানসিকভাবে। আমাদের বংশের কেউ এখানে নেই বলেই হয়তো অনেকেই জনবল থাকা গোষ্ঠিতে যোগ দিয়েছে – এই ধারণা থেকেই শুরু হয় ফুলবাড়িতে বা ডবকায় থাকা আমাদের শেকড়ের খোঁজ। আমাদের পড়াশোনা একটু ব্যাহত হল তখন। ১৯৯০ সালে আমার চোখের সমস্যা নিয়ে আবার তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। আর ১৯৯৩ সাল থেকে ফ্রি কোচিং শুরু করার পর পরিবারের প্রতি তাঁর দায়িত্ব আস্তে আস্তে কমে যেতে শুরু করল। কিন্তু আমাদের সামান্য অসুবিধা দেখলেই তাঁর কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট ধরা পড়ত।

আমার দাদাজি ছেলের জন্য উপযুক্ত পাত্রীর খোঁজ করছিলেন। বাঁশকান্দি এম ভি স্কুলের শিক্ষক সোনাবাড়িঘাটের তজমুল আলি এক পাত্রীর সন্ধান দেন। শিক্ষিত মহিলাকে পুত্রবধু হিসেবে পেতে আমার দাদাজিও খুব উৎসাহ প্রকাশ করেন। প্রস্তাব যায় সোনাবাড়িঘাট বেতখাড়ির বাড়িতে। সানোহর আলি লস্কর ও তউরুন নেসার দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন আমার মা। আমার নানাজি একজন সহজ সরল ধর্মপ্রাণ কৃষিজীবী ছিলেন। নানিজি ছিলেন গৃহবধু, তবে সে যুগের শিক্ষিত পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনিও।। আমার মা-মাসির পড়াশোনার জন্যে সংগ্রাম করেছিলেন তাঁদের কাকা বসির উদ্দিন লস্কর। নিঃসন্দেহে দেবরের পাশে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে সহযোগিতা করেছিলেন নানিজি। এদিকে স্কুলে থাকাকালে প্রধান শিক্ষক আলিম উদ্দিন চৌধুরি ও তাঁর স্ত্রী করণিক আনোয়ারা খাতুন লস্কর (চৌধুরি)-র পছন্দের মানুষ হয়ে ওঠেন আব্বা। আমার মাসি আনোয়ারা তাঁর বোন মনোয়ারা খাতুন লস্করের উপযুক্ত পাত্র হিসেবে মনোনীত করেন তাঁকে। বিয়ে হয়ে গেল ১৯৭২ সালের ২০ এপ্রিল। সেবছর ৫ ডিসেম্বর জুনিয়র বেসিক স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে নিযুক্ত হন মা। তাঁদের সন্তান আমার দাদা শিক্ষকতা করেন, আমিও শিক্ষার সঙ্গে কোনমতে যুক্ত হয়ে আছি, আমার ছোটভাই ব্যবসায়ী আর আমার বোন গৃহবধূ। আমার দুই পিসি খৈরুন নেসা ও করবুল নেসা গৃহবধূ ছিলেন, আমার জ্যাঠা প্রয়াত আয়ীনুল হক লস্কর সমবায় বিভাগে সহকারী সঞ্চালক হয়ে অবসর নেন এবং কাকা সোনাই এমসিডি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন।


নিজের জন্যে কিছু করেননি আব্বা। সহজ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। কোনও বদ অভ্যাস বা নেশা ছিল না তাঁর। উপরি কামাই করার ধান্ধাও ছিলনা। তাঁকে নিয়ে মনে মনে হাসতাম যখন তিনি সগর্বে কিছু উপরি কামাই হয়েছে বলে ঘোষণা করতেন। এই উপরি কামাই ছিল মেট্রিকের ইনভিজিলেশন, সুপারভিশন বা উত্তরপত্র দেখা বাবদ। তবে জানিনা কেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন না। অনেক দুনম্বরি তাঁর চোখের সামনে ঘটত, প্রতিবাদ করতেন না। আমি ধরিয়ে দিলে হেসে বলতেন, ‘ওসব চলে, আমি তো আর করিনা।’ যখন বলতাম, ‘আপনার তো বদনাম হতে পারে।’ রাগ সামলে নিয়ে বলতেন, ‘আমাকে সবাই জানে।’ নিজের চাকরি সংক্রান্ত অনেক ব্যাপারে ঘুষ দিতে হয়েছে তাঁকে, শেষমেষ তাঁর পেনশন পাওয়ার জন্যেও। সরকারি অফিস ওসব বুঝে না। ঘাপটি মেরে বসে আছে সবাই, কোথায় কোন ফাঁক পাওয়া যায়। তারপর তিলকে তাল করে দিনের পর দিন ঘুরিয়ে বৃদ্ধ মানুষকে হয়রান করে দুটি পয়সা কামানো আজও চলে।















শনিবার, ৪ জুলাই, ২০২০

একটু নিজের কথাই বলি -- ২



একটু নিজের কথাই বলি – ২

আর দশটা শিশুর মত আমার ছাত্রজীবন শুরু হয়নি। আমার বাড়ির সদর দরজা আর বাঁশকান্দি এম ভি স্কুলের প্রবেশদ্বার ছিল একেবারেই মুখোমুখি। শুধু রাস্তাটাই পার হওয়া। তখন এটা জাতীয় সড়কও ছিল না, এখনকার গলির মত ছিল। সেই এত কাছের স্কুলে ভর্তি হলেও আমি সেখানে গিয়ে পড়তে পারিনি। আমার মা চাকরি করতেন। বাড়িতে আমার ছোট ভাইবোনের দেখাশোনা করা ছিল আমার দায়িত্ব। আগলে রাখা, দুপুরের খাবার খাওয়ানো ইত্যাদি। স্কুলে না গিয়েও আমার রোল নম্বর এক হয়ে যেত। এভাবে তৃতীয় শ্রেণীতে ওঠার পর বাড়িতে চিঠি এল আমার নাকি নাম কেটে দেওয়া হয়েছে। হেড পণ্ডিত নামর আলি বড়ভুঁইয়ার সামনে হাজির হলাম। অনুরোধ করলাম ভাই-বোনদের কথা বলে। কিন্তু তিনি জানিয়ে দিলেন, স্কুলে আসতেই হবে। সেই থেকেই স্কুল যাওয়া শুরু হল আমার। কিন্তু দুপুর হলেই ছুটে আসতাম বাড়িতে। একবার চিড়ে ভিজিয়ে রেখে গিয়েছিলেন মা। বাটির ঢাকনা খুলতেই কালো পিঁপড়ে আমার হাত মুখ সব ঘিরে ফেলল। কোনও ভাবেই এদের সরাতে পারছিলাম না। ভাই-বোন মুখ বেজার করে সেই দৃশ্য দেখছিল। রাগের মাথায় একটা বড় চামচ দুটুকরো করে ফেললাম। এর পর অনেক খুঁজে একজন কাজের মেয়ে পাওয়া গেল।

স্কুলের ছোট্ট মাঠে কাবাডি কোর্ট বানিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু হাফ টাইমে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রীরা আমাদের মেরে সরিয়ে তারা খেলত। আমি, মইনুল, চয়ন, মাহমুদ, আমির হুসেন, আমির উদ্দিন, আক্তার মিলে ঠিক করলাম যেমন করেই হোক আমাদের কোর্টে এদের আর খেলতে দেওয়া যায় না। যেমন কথা তেমন কাজ। দায়িত্ব পেয়ে আমি কোদাল আনলাম বাড়ি থেকে। তারপর তছনছ হয়ে গেল কোর্টটি। হঠাৎ কে একজন একটা দারুণ বুদ্ধি দিল, ‘কিছু কাঁচ ফেলে দিলে কেমন হয়?’ তাই হল। পরদিন ধরাও পড়ে গেলাম। নীলমণি স্যার, ফজলু স্যার, মুক্তাদির স্যার, মইনুল স্যার মিলে হাত লাল করে ছাড়লেন। সব শুনে আব্বা শুধু বলেছিলেন, শাস্তি তো তোমার প্রাপ্য। আড়ালে গিয়ে মাকে বলেছিলেন, এক হাতে বিশটা করে বেত্রাঘাত বেশি হল না? মা বলেছিলেন, একটা শিক্ষা তো হল। আমারও মনে হয়েছিল কাজটা ভালো করিনি। কিন্তু আমার সঙ্গীরা বলত, আমাদের খেলার ব্যবস্থাটাও হল না, বেকার মার খেতে হল।

স্কুল আমার ভালোই লাগত। বাড়িতে কড়া শাসন ছিল। আমাদের বাড়ির মুখে একটা কাঁঠাল গাছ ছিল আমাদের লক্ষ্মণরেখা। এই গণ্ডির বাইরে যাওয়ার সাহস ছিল না আমাদের। আমার তো একটু বেশিই নিষেধ ছিল। বাবার সঙ্গে বাজার যাওয়া বা ছুটি পেলে আত্মীয়বাড়ি যাওয়া ছিল আমার বাইরে যাওয়া। এই কারণেই বোধ হয় স্কুলের প্রতি একটা টান ছিল। রবীন্দ্রনাথ কেন যে স্কুল পালাতেন তার কারণ আমি অনেক চেষ্টাতেও খুঁজে পেতাম না। ভাবতাম জানলা দিয়ে বাঁশকান্দি আনুয়ার জলের ঝিকিমিকি দেখার সুযোগ পেলে হয়ত তিনিও স্কুল পালিয়ে নদীতীরে গিয়ে বসতেন না।


এভাবেই কেটে গেল চতুর্থ শ্রেণী। বৃত্তি পরীক্ষা দিলাম শিলচরের কোন এক স্কুলে। মা আমাকে নিয়ে গেলেন রেহিমা আন্টির (বাবার মামাতো বোন) মধুরবন্দের ভাড়া বাড়িতে। তিনিও শিক্ষিকা ছিলেন। তাই আমার প্রস্তুতি হয়েছিল খুব। মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দোকানের সাইনবোর্ডে ‘লক্ষীপুর রোড’ কেন লিখা। জানলাম, এই পথেই নাকি বাদ্রিঘাট হয়ে লক্ষীপুর যাতায়াত ছিল। শহরের প্রাণকেন্দ্র নাকি এটাই ছিল। যাই হোক বসলাম পরীক্ষায়। গণিতে সব যেন গুলিয়ে ফেললাম। বৃত্তি পাওয়া আর হল না।

এম ভি স্কুল ছিল সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত। শিক্ষকদের আন্তরিকতাও ছিল। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণীতে এক অজানা কারণে আমি পেছনে পড়ে যাই। পরে উত্তরপত্র পরীক্ষা করে আমার প্রথম স্থান বহাল হয়। বাঁশকান্দি নেনা মিয়া হাই স্কুলে (তখনকার) ভর্তি হলাম ক্লাস ফাইভে। দাদার হাত ধরে অনেক গল্প করতে করতে যাওয়া। দাদা এর আগে রামসুন্দর বালিকা বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন, এছাড়াও তিনি তখন থেকেই মাঝে মাঝে বাজার খরচ করতেন। আমার থেকে তাঁর স্মার্টনেস বেশি ছিল। দাদা মস্তানদের থেকেও আমাকে বাঁচাতেন। আমি হাল্কা রোগা ছেলে ছিলাম। দাদা গোছের ছেলেরা আমাকে জ্বালাতন করত। আমি মুখ বুজে সহ্য করতাম। আস্তে আস্তে সব ঠিক হওয়া শুরু করল।

বড় মাঠ, সুন্দর ঘর, লিচু গাছ, আমগাছ, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঝকঝকে চেহারার শিক্ষক-শিক্ষিকা সব মিলে আমার কাছে স্কুলটি প্রিয় হয়ে উঠল। তখনকার প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন বড়ভুইয়া ছিলেন মার সম্পর্কিত মামা। শিক্ষকরা যেন শিক্ষকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে কোনও একটা অভিযান চালাচ্ছেন মনে হত। কয়েকজন শিক্ষক যে খামখেয়ালি ছিলেন না তা নয়। শিক্ষক-শিক্ষিকারা আমাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন, কারণ আমিও খুব বাধ্য ছাত্র ছিলাম। দুটি সেকশনেই আমাদের ব্যাচটির প্রায় সবাই মেধাবি ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। সেই দলের সর্দার হয়ে গেলাম আমি। মানে আমাকে ক্যাপ্টেন করা হল। ষান্মাসিক পরীক্ষার আগে সহপাঠীদের উদ্বেগ দেখে কয়েকজনকে নিয়ে গেলাম প্রধান শিক্ষকের কাছে। বললাম, ‘আমরা খুব চিন্তিত। প্রশ্নগুলো যেন আমাদের পক্ষে কঠিন না হয়।’ মুচকি হাসার চেষ্টা করেও যেন পারলেন না তিনি, মুখটা হাঁ হয়ে গেল। রাশভারি একজন মানুষের পক্ষে এই হাসিটাও ছিল অট্টহাসির সমান।

অনেক সমস্যা সত্বেও পড়াশোনা থামেনি। মাঝে মাঝে মরে যাওয়ার ইচ্ছে হত। তারপর ভাবতাম আমার মা-বাবার জন্য আমাকে পড়তে হবে, প্রথম সারিতে থাকতে হবে। আব্বা আমাদের নিয়ে খুব পরিশ্রম করতেন, এই একটা কাজেই যেন তিনি আত্মনিয়োগ করলেন। প্রতিযোগিতা ছিল মুলত তিনজনের – শাহারুল, হায়দর (বর্তমানে এই স্কুলেই বিজ্ঞান শিক্ষক) ও আমার। শাহারুলের হস্তাক্ষর ছিল ঈর্ষনীয়। এ ছাড়াও নিলোফার (বর্তমানে এই স্কুলের লজিক শিক্ষিকা), শামিমা (অধ্যাপক আব্দুস সহিদ স্যারের মেয়ে), নাসমিন (স্কুলের অধ্যক্ষের মেয়ে), রনি, ইকবাল, ইসমত, মঞ্জুশ্রী, ইন্দিরা সহ অনেকেই। ক্লাসে বা স্কুল চত্বরে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের মাখামাখি তো দূর, কথা বলা বা তাকানোও ছিল অসম্ভব। মেয়েরা স্কুলে আসত ঘোমটা দিয়ে, তার উপর আবার ছাতা দিয়ে মুখ ঢেকে। এরপরও কিছু বখাটে ছেলে ইভটিজিং করত, তবে আড়ালে তীর্যক মন্তব্য পর্যন্ত সীমিত ছিল তা। আমরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠতে উঠতে ছেলে-মেয়েদের চোখে চোখ রেখে কথা বলা যেন আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করল। কিছু নতুন সমস্যাও দেখা দিল। এভাবেই মাধ্যমিক পরীক্ষা এল। আমি, হায়দর আর নিলোফার প্রথম বিভাগে পাস করলাম। অনেকেই সামান্যের জন্য দ্বিতীয় বিভাগে পাস করল। এরই মধ্যে স্কুলটি উচ্চতর মাধ্যমিক হয়ে গেল। সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। অনেকেই এই স্কুলেই থাকল।

তারপর আমার চোখ অপারেশন। দুবছর পড়া হল না। আর পড়াশোনা করার ইচ্ছে রইল না। দুবছর গ্যাপ দিয়ে ভর্তি হলাম নেনা মিয়া স্কুলেই। ক্লাস আর পাঠ্যপুস্তক ছাড়া অন্য প্রস্তুতি ছিল না। দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হলাম। ইংরাজিতে মাত্র ৮৪ মার্কের উত্তর লিখে পেয়েছিলাম ৭০। আসলে সেও আব্বার অবদান। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আমাকে যে ইংরাজি ব্যাকরণ শিখিয়েছিলেন তার ফল এই। সুলতান স্যার ও ভারতী ম্যাডাম আমাকে শান দিয়ে ঠিক করলেন। ভর্তি হলাম কাছাড় কলেজে ইংরাজি সাম্মানিক নিয়ে। আবার নতুন পরিবেশ। ফাঁক পেলেই বসে যেত গানের আসর। পার্থ, সুব্রত, সিদ্ধার্থ, জয়দীপ, জন আরো অনেক। তারপর আড্ডা দিতে গিয়ে ক্লাস মিস। দোতলার ছাদে বসে জমিয়ে আড্ডা। পড়াশোনাও ছিল। একবার ছাত্র সংসদে সম্পাদক পদের জন্য নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু নির্বাচনটাই রদ হয়ে গেল। বাড়ি থেকে আসা যাওয়া করা সমস্যা। থাকলাম পঞ্চায়েত রোডে। সেখানেও পরিচয় আরো অনেকের সঙ্গে। আবার চোখ অপারেশন। আবার দুবছর গ্যাপ। এবার ভবঘুরে হয়ে গেলাম। পড়াশোনা আর করব না স্থির করলাম। ক্লাব, বিয়েবাড়ি, গানের আসর এসবে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সাইকেলে চড়ে সোনাই, সোনাবাড়িঘাট, শিলচর চক্কর দেওয়া। মাঝে মাঝে লোন নিয়ে কী কী করার পরিকল্পনাও শুরু করে দিলাম।

আব্বা তখন ফ্রি কোচিং ওয়ার্কশপ চালাতেন। সেই সময় আমাদের বাড়িতে এলাকার শিক্ষানুরাগী মানুষের আড্ডা জমত। এই আড্ডার মধ্যমণি জাফরুল হাসান আমাকে একদিন খুব জোরালো ভাষায় বোঝালেন। আমি রাজি হলাম আবার পড়াশোনা শুরু করতে। সঞ্জয়, বাহার, মাহমুদ, কবির পয়লাপুল নেহরু কলেজ থেকে ফর্ম আনল। আমাকে শুধু সই করতে হল। তারপর আবার আরেক যাত্রা। কিছুতেই পড়াশোনায় মন বসে না। বন্ধুসংখ্যা কম রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। এই সময় অধ্যাপক সুর্যকান্ত চক্রবর্তী, অ্যাকাউন্টেন্ট সুনির্মল নাথ, অধ্যাপক গণেশ দে, অধ্যাপক আবিদ রাজা মজুমদার চাইছিলেন শারদোৎসব আয়্যোজন হোক। বার বার চেষ্টা করেও হয়নি। আমরা এগিয়ে এলাম। নেহরু কলেজের ইতিহাসে এই প্রথম শারদোৎসব। আর লুকিয়ে থাকতে পারলাম না। দল বড় হয়ে গেল। বন্ধুদের অনুরোধে ভোটে লড়ে হারলাম। শুরু হয়ে গেল গান, আড্ডা, ঘোরাঘুরি। শ্যামলদার রেস্তোরাঁয় আড্ডা আর জয়পুর, হরিনগর, লাবক, জিরিঘাট, লক্ষীপুর চষে বেড়ানো। পাস করলাম দ্বিতীয় বিভাগে।

এবার আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হলাম। অনেক চেষ্টা করলাম ধারে কাছে একটা মেস বা ভাড়াঘর খুঁজে পাওয়ার। কিন্তু নাম বলতেই বাড়ির মালিক অরাজি হয়ে যেতেন। খবর পেলাম, পয়লাপুলের শিবু কানুনগোর একটা বাড়ি আছে আইরংমারায়। কিন্তু কেয়ারটেকার নাম জিজ্ঞেস করে জানালো ঘর খালি নেই। অপু, বলাই, সব্যসাচীরা খুব চেষ্টা করেও পারল না। অবশেষে রাঙ্গিরখাড়ি আর মেহেরপুরে ভাড়া ঘরে থেকে পড়াশোনা করলাম। যে ঘরে ভাড়া পেলাম না মুসলমান বলে সেই ঘরেই কিন্তু রাত জেগে আড্ডা, গান আর ঘুম চলত আমাদের। পড়াশোনা যাকে বলে তা কিন্তু আমার দ্বারা তখনও হয়ে উঠছিল না। ফলে রেজাল্ট তেমন হল না। তপোধীর স্যারের বকুনি খেতে হয়েছিল। একবার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় জয়শ্রী, অনির্বাণ, অনিরুদ্ধ, মণিদীপা, মনোজ, শতদল সহ এক বড় দল বিভিন্ন ক্ষেত্রে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজয়ী হয়ে মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পাই। ভারতের চারটি এলাকা ভিত্তিক প্রতিযোগিতার পূর্ব জোনের স্থল ছিল এই মেদিনীপুর। সেখানে জয়ী হয়ে দুজন জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় সুযোগ পেয়েছিল। বাকিরা ফিরে এলাম। কিন্তু সেই রেলসফর চিরদিন মনে থাকবে। আমাদের উৎপাতে যাত্রীরা পুরো একটা বগিই আমাদের ছেড়ে দিয়েছিলেন। এতটা হৈ হুল্লোড় করেছিলাম আমরা।

আর পড়াশোনা করব না ঠিক করলাম। একবার আইন পড়তে উদ্বুদ্ধ করল কবির আর আনোয়ার। তাদের সঙ্গে করিমগঞ্জ ল’ কলেজে ভর্তি হলাম। খরচ অনেক কম ছিল বলেই করিমগঞ্জ। সাহায্য করেছিলেন আব্দুল বাসিত স্যার। কিন্তু সে বছর পরীক্ষায় বসা আর হল না। কলেজে কাজ করার সময় মোরাদ আহমেদ লস্করের চাপে সমাজতত্ত্ব পড়তে ভর্তি হলাম কানপুরের ছত্রপতি সাহু জি মহারাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাস করলাম প্রথম বিভাগে। স্কুল পরিচালনা করতে গিয়ে আবার পড়তে হল ডিএলএড। কিছুদিন ধ্রুপদী সঙ্গীতও শিখেছিলাম।

আমি এখনও ছাত্র। কাজ করতে গিয়ে ছোট বড় অনেকের কাছেই শিখি বাধ্য ছাত্রের মতই। আর যত শিখি মনে হয় আমি তো আরো ছোট ছাত্র হয়ে গেছি। এ জীবনে আর জানা হল না, শেখা হল না; হবেও না। নিজেকে তথ্যের ভাণ্ডার বা জিকে বুক বানানোর চেষ্টা করি না। কিন্তু জ্ঞানের সার সত্যটা বুঝে না গেলে জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে – এই ভয় আমাকে কুরে কুরে খায়। এই বিশ্বজগত কি সত্যিই অসীম? সীমাহীন বলে কি কিছু থাকে? অনাদি অনন্ত সময়—সেও কি সম্ভব? ঈশ্বর বলে কেউ আছে যাকে আমরা কল্পনা করি আমাদের মত? তিনি কি আমাদের ডাক শোনেন, না স্টিফেন হকিং এর শরীরে বসানো যন্ত্রের মত আমদের মগজের সঙ্কেত বোঝেন? তিনি কি সত্যিই আমাদের মন্ত্রের ভাষা বোঝেন, না কোনও ভাষার দরকারই নেই তাঁর? তাঁর কি দূত পাঠানোর দরকার আছে? তাঁর কি কোনও আলাদা অস্তিত্ব আছে, না তিনিই সব? এসব প্রশ্নের উত্তর কোন বই পড়ে জানব? বাজারের সব বিক্রেতাই তো বলে, ‘আমারটাই ভালো।’

০৩ জুন, ২০২০