শনিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২০

একটু নিজের কথাই বলি -- ৪ (গ)

 ২০০২ সালে বাগপুরের রহিম উদ্দিন বড়ভূঁইয়া এক প্রস্তাব দিলেন একটি পত্রিকা প্রকাশ করার। সঙ্গে ছিলেন মাসতুতো ভাই রাজু আহমেদ চৌধুরি, বন্ধু কবির আহমেদ লস্কর ও আনোয়ারুল ইসলাম লস্কর। নাম দেওয়া হল ‘আজকের বরাক’। ২০০৩ সালের ১৫ এপ্রিল উন্মোচন করা হল বাঁশকান্দি নেনা মিয়া উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। অতিথি ছিলেন সাময়িক প্রসঙ্গের কর্ণধার তৈমুর রাজা চৌধুরি, উপত্যকার অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ইমাদ উদ্দিন বুলবুল, অধ্যাপক আবিদ রাজা মজুমদার, অধ্যাপক আব্দুস সহিদ চৌধুরি, সাহিত্যিক নবদ্বীপ সিংহ, সমাজকর্মী খায়রুন নেসা চৌধুরি, আধিকারিক রণজিত কুমার লস্কর প্রমুখ। বেশ কয়েকটা সংখ্যা বের হয়। কিন্তু বেশিদুর এগোতে পারেনি। কবির তখন যুগশঙ্খ পত্রিকায় কাজ করত। আমি সেদিন তৈমুর রাজা চৌধুরির কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করলাম সাময়িক প্রসঙ্গ-তে সাংবাদিকতা করার। তিনি কয়েকদিন পরে সম্মতি দিলেন। এদিকে সোনার কাছাড় পত্রিকায় যোগ দিল আনোয়ার। তিনজন মিলে কাজ শুরু করলাম। দিন নেই, রাত নেই। সাময়িক প্রসঙ্গ তখন সবেমাত্র দৈনিক হয়েছে। সোনার কাছাড় অন্তিম লগ্নে। স্কুটার চালিয়ে উগ্রপন্থী অধ্যুষিত পয়লাপুল থেকে শুরু করে লাডুমা, হ্মারখৌলিয়েন, শিবস্থান, শিবপুরি, কুমাছড়া, বেকড়া ইত্যাদি স্থানে যেতে হত। দেখেছি উগ্রপন্থী (ডাকাত) আর নিরাপত্তারক্ষীদের বোঝাপড়ার সহাবস্থান। শরীরের লোম খাড়া হয়ে যেত দু’দিকের বন্দুকধারীদের দেখে। ওই সময় ইন্টারনেট ছিল না। সারাদিন ঘুরে খবর সংগ্রহ করে সন্ধ্যায় ঘুরে আসতাম। তারপর শিলচর গিয়ে পত্রিকা অফিসে বসে খবর লিখে ক্যামেরার রিল কেটে ফটো দিয়ে ঝড়-বৃষ্টি-কুয়াশা-ভয়ঙ্কর অন্ধকার ভেদ করে বাড়ি ফিরে আসতাম। মাঝে মাঝে হকার না আসলে নিজে পত্রিকা বিলিও করতাম। তারপর বাঁশকান্দিতে আবুল বড়ভূঁইয়ার দোকানে বলে কয়ে একটা ফ্যাক্স ম্যাশিন আনালাম। ধীরে ধীরে ওই দোকানে ইমেলের ব্যবহার শুরু হলে ফটো পাঠানোর ব্যবস্থাও করা হল। ২০০৫ সালে দু’হাজার টাকা দিয়ে একটা মোবাইল সিম কিনলাম। একটা নোকিয়া ১১০০ মডেলের সেট পেলাম। ২০০৯ সালে সাংবাদিকতাই ছেড়ে দিলাম। ২০১২ সালে প্রান্তজ্যোতি নতুন করে যাত্রা শুরু করার পর সেখানে কিছুদিন ডেস্কে কাজ করেছি মাধব ভট্টাচার্য, সঞ্জয় রায়, অসীম দত্ত, অসীম আচার্যদের তত্ত্বাবধানে। যাতায়াতের অসুবিধা আর আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য না থাকায় সেখানেও বেশিদিন কাজ করতে পারলাম না। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আবার নতুন করে নিজস্ব উদ্যোগে শুরু করেছি আরেক ধরণের সাংবাদিকতা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায় শেষ হলে তাকে বহু উপরে নিয়ে যেতে চাই।

 


বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেছি বেশ কিছু দিন। ইন্স্যুরেন্সে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমি খুব ভালো বিক্রেতা হতে পারিনি ঠিকই। কিন্তু রোজগার নেহাত কম করিনি। আর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল আমার ব্যক্তিত্বকে গড়ে তোলা। নানা প্রশিক্ষণ আমাকে অভ্যাসের জড়তা কাটিয়ে নিজেকে উপস্থাপন করা শিখিয়েছে। হ্যাঁ, কথার বা মেধার বাজারিকরণ আমার পক্ষে তেমন সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু কৈশোরের আঘাতের দগদগে ঘা সারাতে এই সব মানুষের সান্নিধ্য অনেক সাহায্য করেছিল। আনোয়ার, প্রদীপ সিংহ, দেবাশিষ চৌধুরি তাঁদের মধ্যে অগ্রণী। একটা ব্যাপার বড় মজার ছিল। আমি যখন সরকারি আধিকারিক বা প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির কাছে যেতাম কেমন যেন সব বাধা ডিঙিয়ে তাঁরা আমার একেবারে কাছে চলে আসতেন। কেউ একান্ত পারিবারিক বা ব্যক্তিগত ব্যাপারে মন খুলে কথা বলতে শুরু করে দিতেন। আবার কেউ প্রাচুর্যের ঘেরাটোপে নিজের নিঃসঙ্গতার ডায়েরি খুলে যেন আমার সামনে পড়ে শোনানো পছন্দও করতেন। ইন্স্যুরেন্স অ্যাডভাইজার থেকে ব্যক্তিগত পরামর্শদাতা বা আপনজন হয়ে যেতাম অনেকের। বোধ হয় অনেকের ক্ষেত্রেই এমন হয়, আর তাকেই কাজে লাগান তাঁরা। আমার পক্ষে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

 

আরও অনেক কিছু করেছি জীবনে। সব কথা পাঠকের জন্যে নয়। তার মানে এই নয় যে এসব গোপনীয় ব্যাপার। লিখছি না এই কারণেই যে পাঠকের অন্তরের তন্ত্রীতে সুর তুলতে পারবে না এসব। লিখে রাখব অন্য কোথাও। আরেকটা ব্যাপার সুর তুলতে পারে, আমাদের মনে হাসি-কান্নাময় আনন্দের সঙ্গীত বাজাতে পারে। সেটা কিন্তু পেশা নয় – প্রেম। বেশিদিন বাঁচলে বুড়ো বয়েসে লেখব। তখন এসব কারো সোনার সংসারে হানা দিলেও হাস্যকর হবে, ঘর ভাঙবে না।

 

একটা ঘটনার কথা বলি। ২০১২ সালে আমাকে কেউ গার্লফ্রেন্ডের কথা জিজ্ঞেস করত না, এমনকি বিয়ের কথাও না – সরাসরি জিজ্ঞেস করত ছেলেমেয়ে ক’টা। এমনি এক সময়ে দিসপুরের এক লজের রিসেপশনে কে একজন যেন হঠাৎ আমাকে ডাক দিল পেছন থেকে। ঘুরে দেখলাম বছর পঞ্চাশের জিন্স পেন্ট টি-শার্ট পরা এক অসমিয়া ভদ্রলোক। আমাকে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বিয়ে করছ না কেন?’ অপরিচিত এই মানুষটিকে আমি গুরুত্ব না দেওয়ার চেষ্টা করলাম। সে আমাকে পাঁচটা কথা বলে উধাও হয়ে গেল। এর মধ্যে দুটি ছিল তখনকার অতীত বা বর্তমান – হুবহু মিলে গেল। তিনটি ভবিষ্যতের, তার মধ্যে দুটি মিলেই গেছে। রইল শুধু একটা। যা হিসেব করলে ২০২১ সালে হওয়ার কথা। আমি কিন্তু এসবে বিশ্বাস করি না। তবুও মনে একটা সুপ্ত প্রতীক্ষা রয়েছে সেই দিনটির। কোনও ভাবেই এই সম্ভাবনা দেখিনা, কারণ যা সম্ভাবনা ছিল সব করোনার আঘাতে দুমড়ে মুচড়ে পড়েছে। 


বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

একটু নিজের কথাই বলি -- ৪ (খ)




সমাজকর্ম আমার আরেক কর্মক্ষেত্র, ঠিক পেশা নয়। ছোটবেলায় গ্রামে ক্লাব গঠন করে খেলা-ধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সমাজসেবা করেছি। অনেক সংস্থা গঠন 
করেছি এবং বহু সংস্থায় সাময়িক কাজ করেছি। ২০০৩ সালে আমাকে বরাক হিউম্যান রাইটস প্রটেকশন কমিটিতে যোগ দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করলেন নেহারুল আহমেদ মজুমদার। অনেক ইতস্তত করে শেষমেশ ২০০৪ সালে সদস্য হলাম বিএইচআরপিসি-র। প্রথমটা খুব একটা যোগাযোগ রাখিনি। তারপরে মনে হল সামাজকর্মকে পেশা করলে মন্দ হয় না। কিন্তু গুড়ে বালি পড়ল। কিছু আজগুবি লোকও এই সংস্থায় কাজ করছেন দেখলাম, যাদের উদ্দেশ্য ভালো ছিল না। তারপর দেখলাম কিছু লোক এসে কিসের টাকা ফেরত চাইতে শুরু করল, আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পরে জানলাম, তখনকার সেক্রেটারি নাকি সংস্থায় চাকরি দেওয়ার কথা বলে কিছু টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। একদিন শুনলাম ওই সেক্রেটারি নাকি পুলিশের হেফাজত থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন। সেই থেকে নেহারুল সেক্রেটারি হলেন। কিন্তু আমাদের মাথায় তখন ঋণের বোঝা। টাকাকড়ির ব্যাপারে হবিবুর রহমান চৌধুরি (নববার্তা প্রসঙ্গের মালিক) বা অন্য কেউ কোনও দায় দায়িত্ব নিতেন না। অতএব নেহারুল দায়িত্ব নিলেন, বাকিটা আমার। এবার সংস্থাকে বাঁচাতে লেগে গেলাম। তাই নানা প্রজেক্টের আশায় দৌড়ঝাঁপ শুরু করলাম। কানের জল বের করতে আরো জল ঢালতে শুরু করলাম। একসময় ঋণ নিয়েও বড় বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করলাম। কিন্তু সব জলে গেল। কারণ এ ধরণের সরকার বিরোধী সংস্থা কোনও সরকারি অনুদান পায় না। আর বিদেশি টাকা পাওয়ার মত অবস্থায় আমরা ছিলামও না। আমি তখন কপর্দকশূন্য হয়ে গেলাম। এরই মধ্যে যোগ দিলেন অলিউল্লাহ লস্কর, নানাভাবে সহযোগিতা করলেন বিচারপতি মাহমুদ হুসেন বড়ভুঁইইয়া। আন্তর্জালের ব্যবহার করে বিশ্বের নানা সংস্থার সঙ্গে পরিচয় হল। কিন্তু টাকার বন্দোবস্ত হয় না। নিজের রোজগার আর মার তহবিল থেকে ঋণ শোধ করলাম। এবার সভাপতি হলেন অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক মনীন্দ্র শঙ্কর গুপ্ত। কোনমতে সদস্যদের চাঁদা দিয়ে কাজ চালিয়ে গেলাম। তবে সংস্থা এক নতুন ধারায় কাজ করতে শুরু করল। পরিচয় হল বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে। নানা সংস্থার আয়োজিত প্রশিক্ষণে যোগ দিলাম। সংস্থায় সদস্যদের যোগ-বিয়োগ চলতেই থাকল। বর্তমানে সভাপতি প্রসেনজিত বিশ্বাস ও সচিব প্রধান তানিয়া লস্কর। এখন কিছু সংস্থার সঙ্গে পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে কিছু কাজ করার উপযুক্ত টাকাও আসছে। কিন্তু আমার আর নেহারুলের সেই হারানো টাকা ভুল পথে খরচ হওয়ায় সেই অধ্যায়টা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আমিও অন্যান্য পেশায় জড়িত, তাই পেশাদারি সমাজকর্মে সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। বাকি সব গুছিয়ে নিতে পারলে হয়তো আবার পেশাদার মানবাধিকার কর্মীরূপে ফিরে আসতে পারি।

বিধায়ক রাজদীপ গোয়ালার সঙ্গে,২০১৮ 

মন্ত্রী এসএম দেবের সঙ্গে, দিল্লি, ২০০৪

রাজনীতির প্রতি আমার আকর্ষণ ও অনীহা দুটিই আছে। ক্ষমতায় যারা বসে তাঁদের উপর ছড়ি ঘোরানো আমার ভালো লাগে। সেই সুযোগ তো আর সব সময় পাওয়া যায় না, তাই ভোটের সময় একটু ঝাড়-ফুঁক করি। ছোটবেলায় সে সুযোগ পেতামও। নির্বাচনের সময় এলাকার কিশোরদের নিয়ে একটা অফিস করে বসলাম কারো, সেখানে বসে রাজনীতির গল্প শোনা এক বড় মজার ব্যাপার ছিল আমার কাছে। তারও আগে কমরেড নুরুল হুদার সভায় গিয়ে বসতাম স্কুলের মাঠে। লাল সেলাম, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, নিপাত যাক এসব স্লোগান শিখেছিলাম ওখানে। কে একজন কিশোর একবার একটা গান গেয়েছিলেন ‘পাকের ঘরে আগুন লাগছে থাল ভরি ভাত খাইতেনি…’ । আবছা মনে পড়ে শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার ছিলেন বোধ হয়। আমার ছোট মামার সাইকেলের পিছনে লেখা থাকত ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ছোট নানাজি কমিউনিস্ট ছিলেন। এদিকে লক্ষীপুরে ১৯৮৩ সাল থেকে আমৃত্যু বিধায়ক ছিলেন দীনেশ প্রসাদ গোয়ালা। বাম রাজনীতি ধীরে ধীরে বিলীন হতে শুরু করল। তবে কংগ্রেস তেমন ঘাঁটি গাড়তে পারত না বাঁশকান্দিতে। একবার নেনা মিয়া স্কুলে সন্তোষ মোহন দেবকে অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হয়নি, এমভি স্কুলের সেই সভায় বড় মাপের এই নেতার কাছে বসার সুযোগ পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। আর একবার গনি খান চৌধুরিও নেনা মিয়া স্কুলে সভা করতে সমস্যায় পড়েছিলেন, তখনও তাঁর পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। আর আসাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আকসার ডাকে শিলচর শহরে গিয়ে জেলে যাওয়াও ছিল আমার ছাত্র রাজনীতি। আমি তখন প্রাথমিক স্তরের ছাত্র। আকসার নামে সি-র সঙ্গে কে ও এইচ লাগল পর্যায়ক্রমে। মনে পড়ে আমাদের জন্যে গাড়ি ও খাওয়ার বন্দোবস্ত করতেন সাংসদ রাণা দেব। আকসার নেতার সঙ্গে আমাদের তেমন পরিচয় ছিল না। একবার সদরঘাট পৌঁছতেই এক দাদা গোছের ছেলে এসে বলল, ‘তোমরা বড্ড দেরি করে আসলে দেখছি। সব্বাইকে ধরে নিয়ে গেছে। ভালোই হল। একটা কাজ তোদের করতে হবে। ওই (সুপার বাস) গাড়িগুলো জ্বালিয়ে দে। কিচ্ছু হবেনা। ভাবিস না।’ আমাদের দলে কয়েকজন বড় ছেলেও ছিল। তারা সুপার বাস পোড়ানোর প্রস্তাবটা গিলে বসল। বেঁকে বসলাম আমি। বললাম, ‘আমি ওসব বাজে কাজে নেই, আমাদের কেউ যাবেও না। আর যদি তোমরা যাও তো আমি এখনই হেঁটে বাড়ি ফিরে যাব।’ অগত্যা সবাই ক্ষান্ত হল। আমরা স্লোগান দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। দেবদুতের কাছে পৌঁছতেই পুলিশের গাড়ি এসে আমাদের ধরে নিয়ে গেল। আর ওই দাদা ততক্ষণে হাওয়া হয়ে গেল। একবার কিছুদিনের জন্য আসুতেও যোগ দিয়েছিলাম। বর্তমান উপাধ্যক্ষ আমিনুল হক লস্কর সহ অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয় এরকম এক পুলিশ হেফাজতে। গণনাট্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করে পরিচিত হই নৃত্যগুরু মুকুন্দ ভট্টাচার্য ও অন্যান্য বামপন্থীদের সঙ্গে। কলেজে পড়ার সময় ছাত্র সংসদে নির্দল প্রতিযোগিতা করে হেরেছিলাম। এখনও কোনও দলীয় রাজনীতিতে নেই, তবে নির্বাচন এলে পরিস্থিতি বিবেচনা করে একটু আধটু ঘোরাফেরা করি। তাই রাজনীতি আমার পেশা নয়। আর রাজনীতি কী করে পে
শা হয় সেটা বুঝতেও পারি না। কারণ যারা রাজনীতি করে তাঁরা তোলাবাজি বা ঠিকাদারিও করে, সে অন্য পেশা।

 

মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০২০

একটু নিজের কথাই বলি -- ৩


।। সাদিক মোহাম্মদ লস্কর ।।

আব্বা
মা-বাবা সব জানে – শৈশবে এই বিশ্বাস থাকে আমাদের। কৈশোরের শুরুতে এই বিশ্বাস দুর্বল হতে থাকে, আর এক সময় মনে হয় মা-বাবা বোধ হয় কিচ্ছুই জানে না। যৌবনের শুরুতে এই অবিশ্বাসের ভিত্তিটাও দুর্বল হতে থাকে। মাঝ বয়সে এসে আবার মনে হয় মা-বাবা বোধ হয় সব জানে।এই ধারণা কম-বেশি সবার হয়। আমার ক্ষেত্রেও অনেকটা এরকমই। তবে আব্বা একেবারেই জানেন না, এই ধারণা বোধ হয় তেমন প্রশ্রয় পাওয়ার সুযোগ পায়নি। তিনি শিক্ষকই ছিলেন, আর কিছু না। কিন্তু এই একটি পেশায় এত বৈচিত্র আনা শুধু তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। শরীর ও মনে দৈবশক্তি না থাকলে বোধ হয় একজন পার্থিব মানুষের পক্ষে এতকিছু করা সম্ভব নয়।
সহপাঠীদের সঙ্গে আব্বা

উচ্চতর মাধ্যমিকের শংসাপত্র
আব্বার জন্ম হয় বাঁশকান্দি গ্রামেই। স্বনামধন্য শিক্ষক কামু মিয়া লস্কর ও আকলিমা বেগমের চতুর্থ সন্তান ও দ্বিতীয় ছেলে তিনি। নাম ময়ীনুল হক লস্কর। দলিল মতে তাঁর জন্ম ১৯৪৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। তবে একটু এদিক সেদিক হতেও পারে। অর্থাৎ ১৯৪০-৪২ সাল হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। আমার দাদাজি ৯৮ নম্বর বাঁশকান্দি এল পি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, সেখানেই তিনি পড়তেন। তারপর বাঁশকান্দি মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে। তখন সেখানে চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। এরপর পড়েছেন শিলচর সরকারি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। কনকপুরের মাফিক চৌধুরির বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা করেছেন কিছুদিন। তারপর চলে আসেন বোর্ডিংয়ে। তারপর সাইকেল কেনা হলে সাইকেল চড়ে কাশিপুর-বাদ্রিঘাট হয়ে শিলচর। তখনকার দিনে সাইকেল কেনা অনেক বড় ব্যাপার ছিল। আব্বা বলতেন, হাত একটু বাঁকা করে অনর্থক ক্রিং ক্রিং বেল বাজানোর এক আলাদা মজা ছিল। ১৯৬২ সালে উচ্চতর মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৪ সালে কাছাড় কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৬৭ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। আব্বা কী একটা বৃত্তি পেতেন, তা দিয়েই তাঁর পড়াশোনার খরচ চলত।

বিদায় বেলার কথা
স্নাতক হওয়ার পরই আব্বা চলে যান বাগপুর হাইস্কুলে। তাঁর মামা শিক্ষক মোজাহিদ আলি চৌধুরির ডাক এলো। প্রত্যন্ত বাগপুর এলাকায় স্থাপিত একটা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলতে হবে। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে কাজে যোগ দেন ১৯৬৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। প্রত্যন্ত হলেও প্রাচীন বসতি এই গ্রামে শিক্ষার সম্ভাবনা ছিল। তাই এই মিশন সফল করতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরে প্রধান শিক্ষক আলিম উদ্দিন চৌধুরির সঙ্গে সহকারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন সর্বশক্তি দিয়ে। প্রথমে বেতন ছিল ১৩০ টাকা। প্রায় ১৫ বছর পর ১৯৮২ সালের ১ জানুয়ারি স্কুলটি প্রাদেশিকরণ হয়। বেতন হল ৬২০ টাকা। সহকারি প্রধান শিক্ষক পদ সরকারি ভাবে পেলেন ১৯৮৬ সালের ৪ ডিসেম্বর। ১৯৯৯ সালের ৩০ জুন তিনি প্রধান শিক্ষক হন। ২০০৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অবসর গ্রহণ করেন। এই দিনটি যেন তাঁর কর্মজীবনের অন্তিম দিন ছিল। যেন শুধু স্কুল থেকে নয়, বিশ্বসংসারের সব বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে দিলেন। বেসরকারি স্কুলগুলোর তরফ থেকে লোক এলেন, টাকা-সম্মান সবকিছুর প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু তিনি সবিনয়ে সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। ফ্রি কোচিং ওয়ার্কশপও বন্ধ করে দিলেন। কেন যে তিনি সুস্থ থাকা সত্ত্বেও নিজেকে গুটিয়ে নিলেন তার কারণ খুঁজতে হলে তাঁর অবসর গ্রহণের সময়কার বিদায়ী ভাষণটা পড়তে হবে।

সাইকেল নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে
সংসারে অভাব অনটন লেগেই ছিল। তবুও পিছুটান ছিল না। বাগপুরের মানুষ তাঁদের অ্যাসিস্ট্যান্ট স্যারের সাইকেলের বেল শুনে ঘড়িতে দম দিতেন। আমার জ্যাঠু আইনুল হক লস্কর বাঁশকান্দি নেনা মিয়া উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষকতা করেছিলেন। পরে সমবায় বিভাগের পরিদর্শক পদে চাকরি পেয়ে চলে যান। তিনি আফসোস করতেন, ‘কতবার বললাম, আয় আমার বিভাগে। এল না। বললাম, ফিটনেস আছে, পুলিশে যা। গেল না। আজ এস পি হতে পারত।’ আব্বাকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘কথা ঠিক। কিন্তু আমি তো শিক্ষাব্রতী।’ সেই ব্রত নিয়ে ভেঞ্চার স্কুলে কাজ করেন। প্রাদেশিকীকরণ হওয়ার পরেই যে অভাব মিটে গিয়েছিল তা নয়। ১৯৭৬ সালে একটা সাইকেল কিনেছিলেন আর বোধ হয় কিনলেন ১৯৯৯ সালে। একটা ট্রানজিস্টার কেনার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু পারেননি। জমিজমা তো আর কেনাই হল না। ঘর বানালেন দীর্ঘ ২৫ বছরে (১৯৮৪-২০০৯)। কিন্তু মানুষ গড়ার স্বপ্ন এক মুহুর্তের জন্যেও ফিকে হয়ে যায় নি। অভাব অনটনের অন্য কারণও ছিল।
ছোটবেলায় দেখেছি আব্বার অনেক রকমের বন্ধু ছিলেন। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়তেন। নামাজ আদায় করে সব্জি-বাগান, গোয়ালঘর এইসব সামলে দাড়ি কাটতে বসে পড়তেন। তখনই এসে পড়তেন নানা বয়সের তাঁর বন্ধুরা। সৈয়দ চাচা, মকু ঠাকুর, মামুজি বলে ডাকতেন তাঁদের। এদের প্রায় সবাই ছিল দিনমজুর, কৃষক, অসহায় বৃদ্ধ ইত্যাদি। মনে হত যেন এরা এক একটা বিষয়ে বিশারদ। সব জরুরি পরামর্শ যেন তারাই দিতেন আব্বাকে। চুটিয়ে আড্ডা মেরে ভালো করে প্রাতরাশ করে ঢেঁকুর ছেড়ে বিদেয় নিতেন তাঁরা। এদের সঙ্গে পরামর্শ করাটা আব্বার আসল উদ্দেশ্য ছিল না। আসলে এদের পেটের (ক্ষুধার) খবর তিনি জানতেন। এছাড়াও অর্থ সাহায্য করার সময় যেন কেউ (এমনকি পরিবারের সদস্যরা) দেখতে না পায় সেই সুযোগটাও তো পাওয়া চাই। তাঁর মরদেহের পাশে বসে এক রিক্সাচালক হাউ হাউ করে কেঁদে বলে ফেলেছিলেন, ‘আমাকে সাহায্য করে বলতেন, কাউকে বলো না।’ এমন অনেক কিছুই আছে যা কেউ জানে না, আর কোনও দিন জানতেও পারবে না।

পুরষ্কার দিচ্ছেন ইমাদ উদ্দিন বুলবুল
প্রয়াত নবদ্বীপ সিংহ ও অন্যান্যরা
পুরষ্কার বিতরণে.ডা. কেনোয়ার
জয়পুরে সম্মানিত 
এইসব বদান্যতায় হয়তো তাঁর মন ভরেনি। বাগপুর হাইস্কুলে শিক্ষাদান করেও মন ভরেনি। তাই বৃহত্তর বাঁশকান্দি এলাকার শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের উপায় হিসেবে শুরু করলেন ফ্রি কোচিং ওয়ার্কশপ। ১৯৯৩ সালের ১ মে বাঁশকান্দি মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে শুরু করেন গরিব শিক্ষার্থীদের বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষাদান। পরে অভিভাবকদের দাবি মেনে সবার জন্যেই খুলে দেওয়া হয় এই মানুষ গড়ার কারখানা। ১৯৯৪ সালের ৩০ আগষ্ট লক্ষীপুর খণ্ড প্রাথমিক শিক্ষাধিকারিকের লিখিত অনুমতি নিতে হয়। দিনে অমানুষিক পরিশ্রম, রাত জেগে খাতা দেখা ইত্যাদি ছিল তাঁর রোজকার রুটিন। একটা মহল প্রবল বিরোধিতা শুরু করল। সরকারি শিক্ষক কর্তব্যে ফাঁকি দিয়ে টিউশনির বাজার খুলে তা রক্ষা ও বৃদ্ধির জন্যে নানা ফন্দি ফিকির করতেন, তাঁরা এবং আরও অনেকেই বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তিনি পেয়ে গেলেন এলাকার এক বিজ্ঞান স্নাতক সাজ উদ্দিন লস্করকে। সাধারণ পরিবার থেকে শিক্ষিত হওয়া এই নওজোয়ান কী বুঝে আব্বার উল্টো রথের সারথি হয়ে গেলেন। প্রতি বছর ঘটা করে অনুষ্ঠিত হত পুরস্কার বিতরণ। শুরু হল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। যোগ দিলেন ইমাথৈ সিংহ, বিজন চক্রবর্তী, হীরাকুমারী সহ আরেক দল। তাতেও তৃপ্তি না পেয়ে শুরু করলেন কামু মাস্টার স্মৃতি মেধা পুরস্কার। বাগপুর থেকে বরথল বাগান – নানা জায়গায় গিয়ে পরীক্ষা আয়োজন করা আর পুরস্কার বিতরণ। তারপর একে একে এলেন জাফরুল হাসান বড়ভুঁইয়া, আবুল হুসেন বড়ভুঁইয়া, আব্দুল মতিন লস্কর, মাহমুদ, কবির সহ অনেকেই। কয়েকটি গাড়ি ভাড়া করে দলবল নিয়ে যাওয়া হত। বছরে সামান্য টাকা ফি ধার্য করা হয়েছিল। কিন্তু বাধ্যতামুলক না হওয়ায় বেশিরভাগ অভিভাবক এই টাকা দিতেন না। ফলে এই বিরাট ব্যয়ভার বহন করতে হত তাঁকেই। এইসব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হতেন ডা. কুইন্টিন ডেলবার্ট কেনোয়ার, মন্ত্রী শহিদুল আলম চৌধুরি, উপায়ুক্ত পবন কুমার বড়ঠাকুর, বুদ্ধিজীবী অতীন দাশ, মকব্বির আলি বড়ভুঁইয়া, ইমাদ উদ্দিন বুলবুল, শিখা বড়ঠাকুর প্রমুখ। মন্ত্রী দীনেশ প্রসাদ গোয়ালা কথা দিয়েও একবার এলেন না, শুনেছি স্থানীয় কংগ্রেস কর্মীরা নাকি মানা করেছিলেন তাঁকে। অবসর গ্রহণের পর ফ্রি কোচিং ওয়ার্কশপ বন্ধ করে দেন আব্বা। কিন্তু কামু মাস্টার স্মৃতি মেধা পুরস্কার অতি গোপনে চালিয়ে গেছেন ২০১৩ সাল পর্যন্ত। তাঁর ফাইল ঘাটতে গিয়ে দেখলাম ১০০১ টাকা করে মেধাবি ছাত্র-ছাত্রীদের পুরস্কার দিতেন তিনি।

ধমকি ভরা চিঠি
আব্বা কর্তব্য সম্পাদন করতেন পঞ্চাশ আনা, ষোল আনায় তাঁর মনের ক্ষুধা মিটত না। অর্থাৎ বাগপুর হাইস্কুলে তিনি শুধু রুটিন মাফিক চলা এক শিক্ষকই ছিলেন না। দায়িত্বের বাইরে অনেক কাজ তিনি স্বেচ্ছায় করে যেতেন। খুব আরামে এসব কাজ করতে পারতেন, তা কিন্তু নয়। বাঁশকান্দি থেকে বাগপুরের রাস্তা খুব একটা মসৃণ ছিল না। এঁটেল মাটির রাস্তা, মাঝে সাইকেল চলার ‘লিক’, দুপাশে গভীর নালা। সেই রাস্তায় সাইকেল চালাতে গিয়ে কতবার পড়েছেন, কতবার গরু-মহিষের ধাক্কা খেয়ে নালায় পড়ে কাদা-জলে একাকার হয়েছেন। সহকর্মী ও ছাত্র-ছাত্রীরা সেকালে যে ফিরিস্তা ছিলেন, তা কিন্তু নয়। অনেকবার অনেক কিছু মোকাবেলা করতে হয়েছে তাঁকে। বাগপুর হাইস্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক শুক্কুর আহমেদ বড়ভুঁইয়া এক সভায় বলেছেন, ‘একদিন গরমে অতিষ্ট হয়ে শিক্ষকরা ছুটির আবেদন করলাম। গরম আবার কী – এই বলে চক-ডাস্টার নিয়ে মইন স্যার ক্লাসের দিকে রওনা হয়ে গেলেন। এই প্রৌঢ়ের মনের জোর দেখে লজ্জিত হয়ে তাঁর আগে গিয়ে ক্লাসে পৌঁছলাম।’ হয়তো তিনি নিজের শিক্ষক হিসেবে সমীহ করেছেন; সবাই তো আর করত না। এরকম কোনও এক কারণে তাঁর কাছে আসে এক বেনামি ধমকি ভরা চিঠি। সামলে রেখেছিলেন, এই সেদিন পেয়ে গেলাম সেই চিঠি। এমন আরও কত প্রতিবন্ধকতা ছিল।

আব্বা একজন খুব ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। কৈশোরে যৌবনে অনেক টুর্নামেন্টে খেলেছেন, জেলাস্তরের টুর্নামেন্ট আয়োজনও করেছেন। তাছাড়াও কাবাডি খেলায়ও তাঁর নাম ছিল এলাকায়। তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধু রিয়াজুল হক লস্কর (রিয়াজুল দারোগা), আফতাব আহমেদ (আতাই) প্রমুখ অগ্রজ অনুজ অনেকেই ছিলেন এই খেলার সাথি। সেই কারণেই বোধ হয় সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। সাংস্কৃতিক জগতেও তাঁর কর্মকাণ্ড ছিল। যাত্রা-পালা, নাটক আয়োজন ও অভিনয় করতেন। বিশেষ করে ঐতিহাসিক নাটক বা পাশ্চাত্যের মাহাকাব্যের বঙ্গানুবাদ এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এ ব্যাপারে অবশ্য তাঁর দাদা আয়ীনুল হক লস্কর নেতৃত্ব দিতেন। একটা বড়সড় দল গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু গ্রামের ধর্মীয় ও সামাজিক পরিবেশ দ্রুত পরিবর্তন হওয়ায় এসব থেমে যায় একসময়।

আব্বা ,আমরা ও এক তুতোভাই
মেয়ের কাছে লেখা চিঠি
আমরা ভাই-বোন একটু দেরিতে ৬ টা নাগাদ ঘুম থেকে উঠতাম। আমাদের প্রাতরাশ হয়ে গেলে পড়ানো শুরু করতেন আব্বা। ততক্ষণে তাঁর প্রথম সারির বন্ধুরা বিদেয় নিয়ে নিয়েছেন। ফজরের নামাজের সময় দেখা করে নিতেন তাঁর প্রায় সমবয়েসী বন্ধু রিয়াজুল হক লস্কর (দারোগা), মশরফ আলি বড়ভুঁইয়া (ব্যবসায়ী), সাজ্জাদুর বড়ভুঁইয়া (সইজ্জা পাটোয়ারি) সহ গ্রামের তখনকার মুরব্বিদের সঙ্গে।  তখন সাড়ে ১০ টায় স্কুলের ঘন্টি বাজত। ৯ টা নাগাদ আমাদের শিক্ষাদান শেষ করে স্নান করাতেন। গরমের দিনে আমাদের স্নান করাতে নিয়ে যেতেন বাঁশকান্দি আনুয়ায়। আনুয়ার ফটিক স্বচ্ছ জলে সাঁতার দেওয়া, হাঁস আর পরিযায়ী পাখির লীলা, ঊর্মিমালায় সকালের রৌদ্রের বিচ্ছুরণ, হাঁটুজলে বালির উপর মাছের ঘোরাঘুরি, দুরের ঘাটে ধোপার কাপড় আছাড় মারার অনেক পর আওয়াজ শোনার কারণ এইসব দেখানো আর শেখানো ছিল তাঁর আনুষঙ্গিক কাজ। সন্ধ্যার পর থেকে রাত নটা অবধি আরেক দফা পড়াশোনা। সন্ধেবেলা মাও কিছু পড়ানোর সময় পেতেন। ১৯৮৫ সালে আমাদের প্রতিবেশির সঙ্গে এক ছোটখাটো যুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মামলা মোকদ্দমা ছাড়াও এতদিনের সুহৃদ বা বন্ধুদের একাংশের অপর পক্ষ অবলম্বন বা নেতিবাচক ভুমিকা দেখে বেশ আহত হয়েছিলেন মানসিকভাবে। আমাদের বংশের কেউ এখানে নেই বলেই হয়তো অনেকেই জনবল থাকা গোষ্ঠিতে যোগ দিয়েছে – এই ধারণা থেকেই শুরু হয় ফুলবাড়িতে বা ডবকায় থাকা আমাদের শেকড়ের খোঁজ। আমাদের পড়াশোনা একটু ব্যাহত হল তখন। ১৯৯০ সালে আমার চোখের সমস্যা নিয়ে আবার তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। আর ১৯৯৩ সাল থেকে ফ্রি কোচিং শুরু করার পর পরিবারের প্রতি তাঁর দায়িত্ব আস্তে আস্তে কমে যেতে শুরু করল। কিন্তু আমাদের সামান্য অসুবিধা দেখলেই তাঁর কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট ধরা পড়ত।

আমার দাদাজি ছেলের জন্য উপযুক্ত পাত্রীর খোঁজ করছিলেন। বাঁশকান্দি এম ভি স্কুলের শিক্ষক সোনাবাড়িঘাটের তজমুল আলি এক পাত্রীর সন্ধান দেন। শিক্ষিত মহিলাকে পুত্রবধু হিসেবে পেতে আমার দাদাজিও খুব উৎসাহ প্রকাশ করেন। প্রস্তাব যায় সোনাবাড়িঘাট বেতখাড়ির বাড়িতে। সানোহর আলি লস্কর ও তউরুন নেসার দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন আমার মা। আমার নানাজি একজন সহজ সরল ধর্মপ্রাণ কৃষিজীবী ছিলেন। নানিজি ছিলেন গৃহবধু, তবে সে যুগের শিক্ষিত পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনিও।। আমার মা-মাসির পড়াশোনার জন্যে সংগ্রাম করেছিলেন তাঁদের কাকা বসির উদ্দিন লস্কর। নিঃসন্দেহে দেবরের পাশে দাঁড়িয়ে আড়াল থেকে সহযোগিতা করেছিলেন নানিজি। এদিকে স্কুলে থাকাকালে প্রধান শিক্ষক আলিম উদ্দিন চৌধুরি ও তাঁর স্ত্রী করণিক আনোয়ারা খাতুন লস্কর (চৌধুরি)-র পছন্দের মানুষ হয়ে ওঠেন আব্বা। আমার মাসি আনোয়ারা তাঁর বোন মনোয়ারা খাতুন লস্করের উপযুক্ত পাত্র হিসেবে মনোনীত করেন তাঁকে। বিয়ে হয়ে গেল ১৯৭২ সালের ২০ এপ্রিল। সেবছর ৫ ডিসেম্বর জুনিয়র বেসিক স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে নিযুক্ত হন মা। তাঁদের সন্তান আমার দাদা শিক্ষকতা করেন, আমিও শিক্ষার সঙ্গে কোনমতে যুক্ত হয়ে আছি, আমার ছোটভাই ব্যবসায়ী আর আমার বোন গৃহবধূ। আমার দুই পিসি খৈরুন নেসা ও করবুল নেসা গৃহবধূ ছিলেন, আমার জ্যাঠা প্রয়াত আয়ীনুল হক লস্কর সমবায় বিভাগে সহকারী সঞ্চালক হয়ে অবসর নেন এবং কাকা সোনাই এমসিডি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন।


নিজের জন্যে কিছু করেননি আব্বা। সহজ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। কোনও বদ অভ্যাস বা নেশা ছিল না তাঁর। উপরি কামাই করার ধান্ধাও ছিলনা। তাঁকে নিয়ে মনে মনে হাসতাম যখন তিনি সগর্বে কিছু উপরি কামাই হয়েছে বলে ঘোষণা করতেন। এই উপরি কামাই ছিল মেট্রিকের ইনভিজিলেশন, সুপারভিশন বা উত্তরপত্র দেখা বাবদ। তবে জানিনা কেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন না। অনেক দুনম্বরি তাঁর চোখের সামনে ঘটত, প্রতিবাদ করতেন না। আমি ধরিয়ে দিলে হেসে বলতেন, ‘ওসব চলে, আমি তো আর করিনা।’ যখন বলতাম, ‘আপনার তো বদনাম হতে পারে।’ রাগ সামলে নিয়ে বলতেন, ‘আমাকে সবাই জানে।’ নিজের চাকরি সংক্রান্ত অনেক ব্যাপারে ঘুষ দিতে হয়েছে তাঁকে, শেষমেষ তাঁর পেনশন পাওয়ার জন্যেও। সরকারি অফিস ওসব বুঝে না। ঘাপটি মেরে বসে আছে সবাই, কোথায় কোন ফাঁক পাওয়া যায়। তারপর তিলকে তাল করে দিনের পর দিন ঘুরিয়ে বৃদ্ধ মানুষকে হয়রান করে দুটি পয়সা কামানো আজও চলে।















শনিবার, ৪ জুলাই, ২০২০

একটু নিজের কথাই বলি -- ২



একটু নিজের কথাই বলি – ২

আর দশটা শিশুর মত আমার ছাত্রজীবন শুরু হয়নি। আমার বাড়ির সদর দরজা আর বাঁশকান্দি এম ভি স্কুলের প্রবেশদ্বার ছিল একেবারেই মুখোমুখি। শুধু রাস্তাটাই পার হওয়া। তখন এটা জাতীয় সড়কও ছিল না, এখনকার গলির মত ছিল। সেই এত কাছের স্কুলে ভর্তি হলেও আমি সেখানে গিয়ে পড়তে পারিনি। আমার মা চাকরি করতেন। বাড়িতে আমার ছোট ভাইবোনের দেখাশোনা করা ছিল আমার দায়িত্ব। আগলে রাখা, দুপুরের খাবার খাওয়ানো ইত্যাদি। স্কুলে না গিয়েও আমার রোল নম্বর এক হয়ে যেত। এভাবে তৃতীয় শ্রেণীতে ওঠার পর বাড়িতে চিঠি এল আমার নাকি নাম কেটে দেওয়া হয়েছে। হেড পণ্ডিত নামর আলি বড়ভুঁইয়ার সামনে হাজির হলাম। অনুরোধ করলাম ভাই-বোনদের কথা বলে। কিন্তু তিনি জানিয়ে দিলেন, স্কুলে আসতেই হবে। সেই থেকেই স্কুল যাওয়া শুরু হল আমার। কিন্তু দুপুর হলেই ছুটে আসতাম বাড়িতে। একবার চিড়ে ভিজিয়ে রেখে গিয়েছিলেন মা। বাটির ঢাকনা খুলতেই কালো পিঁপড়ে আমার হাত মুখ সব ঘিরে ফেলল। কোনও ভাবেই এদের সরাতে পারছিলাম না। ভাই-বোন মুখ বেজার করে সেই দৃশ্য দেখছিল। রাগের মাথায় একটা বড় চামচ দুটুকরো করে ফেললাম। এর পর অনেক খুঁজে একজন কাজের মেয়ে পাওয়া গেল।

স্কুলের ছোট্ট মাঠে কাবাডি কোর্ট বানিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু হাফ টাইমে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রীরা আমাদের মেরে সরিয়ে তারা খেলত। আমি, মইনুল, চয়ন, মাহমুদ, আমির হুসেন, আমির উদ্দিন, আক্তার মিলে ঠিক করলাম যেমন করেই হোক আমাদের কোর্টে এদের আর খেলতে দেওয়া যায় না। যেমন কথা তেমন কাজ। দায়িত্ব পেয়ে আমি কোদাল আনলাম বাড়ি থেকে। তারপর তছনছ হয়ে গেল কোর্টটি। হঠাৎ কে একজন একটা দারুণ বুদ্ধি দিল, ‘কিছু কাঁচ ফেলে দিলে কেমন হয়?’ তাই হল। পরদিন ধরাও পড়ে গেলাম। নীলমণি স্যার, ফজলু স্যার, মুক্তাদির স্যার, মইনুল স্যার মিলে হাত লাল করে ছাড়লেন। সব শুনে আব্বা শুধু বলেছিলেন, শাস্তি তো তোমার প্রাপ্য। আড়ালে গিয়ে মাকে বলেছিলেন, এক হাতে বিশটা করে বেত্রাঘাত বেশি হল না? মা বলেছিলেন, একটা শিক্ষা তো হল। আমারও মনে হয়েছিল কাজটা ভালো করিনি। কিন্তু আমার সঙ্গীরা বলত, আমাদের খেলার ব্যবস্থাটাও হল না, বেকার মার খেতে হল।

স্কুল আমার ভালোই লাগত। বাড়িতে কড়া শাসন ছিল। আমাদের বাড়ির মুখে একটা কাঁঠাল গাছ ছিল আমাদের লক্ষ্মণরেখা। এই গণ্ডির বাইরে যাওয়ার সাহস ছিল না আমাদের। আমার তো একটু বেশিই নিষেধ ছিল। বাবার সঙ্গে বাজার যাওয়া বা ছুটি পেলে আত্মীয়বাড়ি যাওয়া ছিল আমার বাইরে যাওয়া। এই কারণেই বোধ হয় স্কুলের প্রতি একটা টান ছিল। রবীন্দ্রনাথ কেন যে স্কুল পালাতেন তার কারণ আমি অনেক চেষ্টাতেও খুঁজে পেতাম না। ভাবতাম জানলা দিয়ে বাঁশকান্দি আনুয়ার জলের ঝিকিমিকি দেখার সুযোগ পেলে হয়ত তিনিও স্কুল পালিয়ে নদীতীরে গিয়ে বসতেন না।


এভাবেই কেটে গেল চতুর্থ শ্রেণী। বৃত্তি পরীক্ষা দিলাম শিলচরের কোন এক স্কুলে। মা আমাকে নিয়ে গেলেন রেহিমা আন্টির (বাবার মামাতো বোন) মধুরবন্দের ভাড়া বাড়িতে। তিনিও শিক্ষিকা ছিলেন। তাই আমার প্রস্তুতি হয়েছিল খুব। মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দোকানের সাইনবোর্ডে ‘লক্ষীপুর রোড’ কেন লিখা। জানলাম, এই পথেই নাকি বাদ্রিঘাট হয়ে লক্ষীপুর যাতায়াত ছিল। শহরের প্রাণকেন্দ্র নাকি এটাই ছিল। যাই হোক বসলাম পরীক্ষায়। গণিতে সব যেন গুলিয়ে ফেললাম। বৃত্তি পাওয়া আর হল না।

এম ভি স্কুল ছিল সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত। শিক্ষকদের আন্তরিকতাও ছিল। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণীতে এক অজানা কারণে আমি পেছনে পড়ে যাই। পরে উত্তরপত্র পরীক্ষা করে আমার প্রথম স্থান বহাল হয়। বাঁশকান্দি নেনা মিয়া হাই স্কুলে (তখনকার) ভর্তি হলাম ক্লাস ফাইভে। দাদার হাত ধরে অনেক গল্প করতে করতে যাওয়া। দাদা এর আগে রামসুন্দর বালিকা বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন, এছাড়াও তিনি তখন থেকেই মাঝে মাঝে বাজার খরচ করতেন। আমার থেকে তাঁর স্মার্টনেস বেশি ছিল। দাদা মস্তানদের থেকেও আমাকে বাঁচাতেন। আমি হাল্কা রোগা ছেলে ছিলাম। দাদা গোছের ছেলেরা আমাকে জ্বালাতন করত। আমি মুখ বুজে সহ্য করতাম। আস্তে আস্তে সব ঠিক হওয়া শুরু করল।

বড় মাঠ, সুন্দর ঘর, লিচু গাছ, আমগাছ, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঝকঝকে চেহারার শিক্ষক-শিক্ষিকা সব মিলে আমার কাছে স্কুলটি প্রিয় হয়ে উঠল। তখনকার প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন বড়ভুইয়া ছিলেন মার সম্পর্কিত মামা। শিক্ষকরা যেন শিক্ষকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে কোনও একটা অভিযান চালাচ্ছেন মনে হত। কয়েকজন শিক্ষক যে খামখেয়ালি ছিলেন না তা নয়। শিক্ষক-শিক্ষিকারা আমাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন, কারণ আমিও খুব বাধ্য ছাত্র ছিলাম। দুটি সেকশনেই আমাদের ব্যাচটির প্রায় সবাই মেধাবি ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। সেই দলের সর্দার হয়ে গেলাম আমি। মানে আমাকে ক্যাপ্টেন করা হল। ষান্মাসিক পরীক্ষার আগে সহপাঠীদের উদ্বেগ দেখে কয়েকজনকে নিয়ে গেলাম প্রধান শিক্ষকের কাছে। বললাম, ‘আমরা খুব চিন্তিত। প্রশ্নগুলো যেন আমাদের পক্ষে কঠিন না হয়।’ মুচকি হাসার চেষ্টা করেও যেন পারলেন না তিনি, মুখটা হাঁ হয়ে গেল। রাশভারি একজন মানুষের পক্ষে এই হাসিটাও ছিল অট্টহাসির সমান।

অনেক সমস্যা সত্বেও পড়াশোনা থামেনি। মাঝে মাঝে মরে যাওয়ার ইচ্ছে হত। তারপর ভাবতাম আমার মা-বাবার জন্য আমাকে পড়তে হবে, প্রথম সারিতে থাকতে হবে। আব্বা আমাদের নিয়ে খুব পরিশ্রম করতেন, এই একটা কাজেই যেন তিনি আত্মনিয়োগ করলেন। প্রতিযোগিতা ছিল মুলত তিনজনের – শাহারুল, হায়দর (বর্তমানে এই স্কুলেই বিজ্ঞান শিক্ষক) ও আমার। শাহারুলের হস্তাক্ষর ছিল ঈর্ষনীয়। এ ছাড়াও নিলোফার (বর্তমানে এই স্কুলের লজিক শিক্ষিকা), শামিমা (অধ্যাপক আব্দুস সহিদ স্যারের মেয়ে), নাসমিন (স্কুলের অধ্যক্ষের মেয়ে), রনি, ইকবাল, ইসমত, মঞ্জুশ্রী, ইন্দিরা সহ অনেকেই। ক্লাসে বা স্কুল চত্বরে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের মাখামাখি তো দূর, কথা বলা বা তাকানোও ছিল অসম্ভব। মেয়েরা স্কুলে আসত ঘোমটা দিয়ে, তার উপর আবার ছাতা দিয়ে মুখ ঢেকে। এরপরও কিছু বখাটে ছেলে ইভটিজিং করত, তবে আড়ালে তীর্যক মন্তব্য পর্যন্ত সীমিত ছিল তা। আমরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠতে উঠতে ছেলে-মেয়েদের চোখে চোখ রেখে কথা বলা যেন আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করল। কিছু নতুন সমস্যাও দেখা দিল। এভাবেই মাধ্যমিক পরীক্ষা এল। আমি, হায়দর আর নিলোফার প্রথম বিভাগে পাস করলাম। অনেকেই সামান্যের জন্য দ্বিতীয় বিভাগে পাস করল। এরই মধ্যে স্কুলটি উচ্চতর মাধ্যমিক হয়ে গেল। সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। অনেকেই এই স্কুলেই থাকল।

তারপর আমার চোখ অপারেশন। দুবছর পড়া হল না। আর পড়াশোনা করার ইচ্ছে রইল না। দুবছর গ্যাপ দিয়ে ভর্তি হলাম নেনা মিয়া স্কুলেই। ক্লাস আর পাঠ্যপুস্তক ছাড়া অন্য প্রস্তুতি ছিল না। দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হলাম। ইংরাজিতে মাত্র ৮৪ মার্কের উত্তর লিখে পেয়েছিলাম ৭০। আসলে সেও আব্বার অবদান। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আমাকে যে ইংরাজি ব্যাকরণ শিখিয়েছিলেন তার ফল এই। সুলতান স্যার ও ভারতী ম্যাডাম আমাকে শান দিয়ে ঠিক করলেন। ভর্তি হলাম কাছাড় কলেজে ইংরাজি সাম্মানিক নিয়ে। আবার নতুন পরিবেশ। ফাঁক পেলেই বসে যেত গানের আসর। পার্থ, সুব্রত, সিদ্ধার্থ, জয়দীপ, জন আরো অনেক। তারপর আড্ডা দিতে গিয়ে ক্লাস মিস। দোতলার ছাদে বসে জমিয়ে আড্ডা। পড়াশোনাও ছিল। একবার ছাত্র সংসদে সম্পাদক পদের জন্য নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু নির্বাচনটাই রদ হয়ে গেল। বাড়ি থেকে আসা যাওয়া করা সমস্যা। থাকলাম পঞ্চায়েত রোডে। সেখানেও পরিচয় আরো অনেকের সঙ্গে। আবার চোখ অপারেশন। আবার দুবছর গ্যাপ। এবার ভবঘুরে হয়ে গেলাম। পড়াশোনা আর করব না স্থির করলাম। ক্লাব, বিয়েবাড়ি, গানের আসর এসবে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সাইকেলে চড়ে সোনাই, সোনাবাড়িঘাট, শিলচর চক্কর দেওয়া। মাঝে মাঝে লোন নিয়ে কী কী করার পরিকল্পনাও শুরু করে দিলাম।

আব্বা তখন ফ্রি কোচিং ওয়ার্কশপ চালাতেন। সেই সময় আমাদের বাড়িতে এলাকার শিক্ষানুরাগী মানুষের আড্ডা জমত। এই আড্ডার মধ্যমণি জাফরুল হাসান আমাকে একদিন খুব জোরালো ভাষায় বোঝালেন। আমি রাজি হলাম আবার পড়াশোনা শুরু করতে। সঞ্জয়, বাহার, মাহমুদ, কবির পয়লাপুল নেহরু কলেজ থেকে ফর্ম আনল। আমাকে শুধু সই করতে হল। তারপর আবার আরেক যাত্রা। কিছুতেই পড়াশোনায় মন বসে না। বন্ধুসংখ্যা কম রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। এই সময় অধ্যাপক সুর্যকান্ত চক্রবর্তী, অ্যাকাউন্টেন্ট সুনির্মল নাথ, অধ্যাপক গণেশ দে, অধ্যাপক আবিদ রাজা মজুমদার চাইছিলেন শারদোৎসব আয়্যোজন হোক। বার বার চেষ্টা করেও হয়নি। আমরা এগিয়ে এলাম। নেহরু কলেজের ইতিহাসে এই প্রথম শারদোৎসব। আর লুকিয়ে থাকতে পারলাম না। দল বড় হয়ে গেল। বন্ধুদের অনুরোধে ভোটে লড়ে হারলাম। শুরু হয়ে গেল গান, আড্ডা, ঘোরাঘুরি। শ্যামলদার রেস্তোরাঁয় আড্ডা আর জয়পুর, হরিনগর, লাবক, জিরিঘাট, লক্ষীপুর চষে বেড়ানো। পাস করলাম দ্বিতীয় বিভাগে।

এবার আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হলাম। অনেক চেষ্টা করলাম ধারে কাছে একটা মেস বা ভাড়াঘর খুঁজে পাওয়ার। কিন্তু নাম বলতেই বাড়ির মালিক অরাজি হয়ে যেতেন। খবর পেলাম, পয়লাপুলের শিবু কানুনগোর একটা বাড়ি আছে আইরংমারায়। কিন্তু কেয়ারটেকার নাম জিজ্ঞেস করে জানালো ঘর খালি নেই। অপু, বলাই, সব্যসাচীরা খুব চেষ্টা করেও পারল না। অবশেষে রাঙ্গিরখাড়ি আর মেহেরপুরে ভাড়া ঘরে থেকে পড়াশোনা করলাম। যে ঘরে ভাড়া পেলাম না মুসলমান বলে সেই ঘরেই কিন্তু রাত জেগে আড্ডা, গান আর ঘুম চলত আমাদের। পড়াশোনা যাকে বলে তা কিন্তু আমার দ্বারা তখনও হয়ে উঠছিল না। ফলে রেজাল্ট তেমন হল না। তপোধীর স্যারের বকুনি খেতে হয়েছিল। একবার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় জয়শ্রী, অনির্বাণ, অনিরুদ্ধ, মণিদীপা, মনোজ, শতদল সহ এক বড় দল বিভিন্ন ক্ষেত্রে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজয়ী হয়ে মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পাই। ভারতের চারটি এলাকা ভিত্তিক প্রতিযোগিতার পূর্ব জোনের স্থল ছিল এই মেদিনীপুর। সেখানে জয়ী হয়ে দুজন জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় সুযোগ পেয়েছিল। বাকিরা ফিরে এলাম। কিন্তু সেই রেলসফর চিরদিন মনে থাকবে। আমাদের উৎপাতে যাত্রীরা পুরো একটা বগিই আমাদের ছেড়ে দিয়েছিলেন। এতটা হৈ হুল্লোড় করেছিলাম আমরা।

আর পড়াশোনা করব না ঠিক করলাম। একবার আইন পড়তে উদ্বুদ্ধ করল কবির আর আনোয়ার। তাদের সঙ্গে করিমগঞ্জ ল’ কলেজে ভর্তি হলাম। খরচ অনেক কম ছিল বলেই করিমগঞ্জ। সাহায্য করেছিলেন আব্দুল বাসিত স্যার। কিন্তু সে বছর পরীক্ষায় বসা আর হল না। কলেজে কাজ করার সময় মোরাদ আহমেদ লস্করের চাপে সমাজতত্ত্ব পড়তে ভর্তি হলাম কানপুরের ছত্রপতি সাহু জি মহারাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাস করলাম প্রথম বিভাগে। স্কুল পরিচালনা করতে গিয়ে আবার পড়তে হল ডিএলএড। কিছুদিন ধ্রুপদী সঙ্গীতও শিখেছিলাম।

আমি এখনও ছাত্র। কাজ করতে গিয়ে ছোট বড় অনেকের কাছেই শিখি বাধ্য ছাত্রের মতই। আর যত শিখি মনে হয় আমি তো আরো ছোট ছাত্র হয়ে গেছি। এ জীবনে আর জানা হল না, শেখা হল না; হবেও না। নিজেকে তথ্যের ভাণ্ডার বা জিকে বুক বানানোর চেষ্টা করি না। কিন্তু জ্ঞানের সার সত্যটা বুঝে না গেলে জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে – এই ভয় আমাকে কুরে কুরে খায়। এই বিশ্বজগত কি সত্যিই অসীম? সীমাহীন বলে কি কিছু থাকে? অনাদি অনন্ত সময়—সেও কি সম্ভব? ঈশ্বর বলে কেউ আছে যাকে আমরা কল্পনা করি আমাদের মত? তিনি কি আমাদের ডাক শোনেন, না স্টিফেন হকিং এর শরীরে বসানো যন্ত্রের মত আমদের মগজের সঙ্কেত বোঝেন? তিনি কি সত্যিই আমাদের মন্ত্রের ভাষা বোঝেন, না কোনও ভাষার দরকারই নেই তাঁর? তাঁর কি দূত পাঠানোর দরকার আছে? তাঁর কি কোনও আলাদা অস্তিত্ব আছে, না তিনিই সব? এসব প্রশ্নের উত্তর কোন বই পড়ে জানব? বাজারের সব বিক্রেতাই তো বলে, ‘আমারটাই ভালো।’

০৩ জুন, ২০২০


শনিবার, ৩০ মে, ২০২০

একটু নিজের কথাই বলি


একটু নিজের কথাই বলি

পৃথিবীতে আমার আসাটাই এক দুর্ঘটনা মাত্র। এক অপ্রত্যাশিত অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপার। আমার জন্যে কেউ বুক বেঁধে অপেক্ষা করেনি, বরং এক আপদ হিসেবে দেখাটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ আমার জন্মের সময় আমার দাদার বয়স ছিল মাত্র এক বছর। দাদার প্রাপ্য যত্ন, খাদ্য সবকিছুই আমার কারণে কমে গেল। বাঁশকান্দির অদুরে আলিপুরের বারোজ মেমোরিয়াল খ্রীস্টিয়ান হসপিটাল-এ আমার জন্ম। তারপর বড় হয়ে ওঠা বাঁশকান্দির পৈতৃক বাড়িটিতে। শিলচর-ইম্ফল জাতীয় সড়কটি আমাদের বাড়ি আর ১৯০৪ সালে স্থাপিত বাঁশকান্দি মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ের সীমারেখার মত মাঝখান দিয়ে গেছে।

আমার দান বা প্রাপ্তি কোনোটাই তেমন বড় নয়। এরকম মানুষের নিজের কথা লেখা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং হাস্যকর হতে পারে অনেকের কাছে। যদি তাই হয় তবে বুঝে নিতে হবে এই একটা কাজের কাজ হল আমার জীবনে, মানুষকে হাসানোর মত একটা বড় কাজ আমি করতে পেরেছি। কেউ আড়ালে বিদ্রূপ করলেও বুঝে নেব আমি কিছু কাজ করেছি। কেউ গালি দিলে বুঝব আমার শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন।

আমার জীবনে অনেক অনেক অভিজ্ঞতা আছে যা ঐতিহাসিক না হলেও কিছু ছবি তুলে ধরতে পারে। অনেক পারিপার্শ্বিক ব্যাপার হতে পারে সময়ের দলিল। আমার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পেশা, গ্রামের খুঁটিনাটি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তির পরিচয় পর্যায়ক্রমে তুলে ধরতে চাই। আশা করি এসব আমার আত্মপরিচয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আর শুধু শুধু বড়লোকের কথাই শুনব কেন? আমাদের জীবনেও তো অনেক উত্থান পতন আছে। আমাদেরও তো কিছু না বলা কথা আছে।

সমাজকে অনেক কিছুই দেয় একজন ব্যক্তি। তার লক্ষে অলক্ষে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে একজন সাধারণ ব্যক্তি পাওয়ার চাইতে দেয় বেশি। কারণ সে যে রোজগার করে তার একটা বড়ো অংশ সে এই সমাজের স্বার্থে ব্যয় করে। শুধু অর্থ নয়, তার সময়, শক্তি, সুখ, স্বাধীনতা অনেক কিছুই সে সমাজের জন্য বিসর্জন করে। সমাজ তার দায়িত্ব নেয় ঠিকই, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যায়। তো দাঁড়ালো এই যে প্রত্যেক ব্যক্তি সচেতনভাবে সমাজকে দেয় না। যারা দেয় না তারাই শীর্ষ আসনে বসে বাকিদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের দান প্রাপ্তির চাইতে অনেক কম। কিন্তু হিসেবের তালিকায় সেই নাম বড়ো হরফে লেখা থাকে। অথচ যারা নানা দ্বিধায় নিজের প্রাপ্তির রাশিকে বড়ো করতে পারে না তাদের দান তালিকায় বাদ পড়ে যায় এই বলে, যে ভিক্ষা তারা পেয়েছে এ তারই প্রতিদান মাত্র। অথচ মানুষ সমাজে বাস করে এই আশায় যে সমাজ তাকে সুরক্ষা দেবে প্রতি মুহুর্তে আর আপদকালে এই সুরক্ষা এতো বড়ো হবে যে তা দেখা যাবে সহজে। কিন্তু তা হয় না। হয় না বলেই বড়লোকদের বাড়ি ফেরাতে গিয়ে সারা দেশ তালা মারতে হল আর গরিব বাড়ি ফিরতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়ে, সরকারি লাঠির আঘাতে বা অনাহারে মারা পড়ে। বড়লোকের হাজার কোটি টাকার ঋণ মকুব হয় অনায়াসে আর কৃষক ঋণ খেলাপির দায়ে আত্মহত্যা করে।

কিন্তু তারপরেও তো ছোটলোকের লাশের উপর পা রেখে বেশিদিন চলতে পারে না বড়লোক। ছোটলোক ঘরে বসে মরলে বড়লোকের গাড়ি চলে না, বাড়ি চলে না, কল-কারখানা চলে না। পিরামিডের নিচের সারিতে যারা আছি আমরা আমাদের কথাও কিছু বলি। এখানে কাদা আছে, জোঁক কামড়ায়, নোংরা ধুলা শরীরে লাগে। কিন্তু এই সব এক একটা দলিল।



একটু নিজের কথাই বলি – ১

মার কাছে শুনলাম, জন্মের পর সুস্থই ছিলাম আমি। তিনি ঠাট্টা করে বলেন, বোধ হয় নজর লেগেছিল। চল্লিশ দিন পূর্ণ হতেই শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। স্থানীয় ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দেন। তখন যাতায়াত-যোগাযোগ ভালো ছিল না, শহরে নিতে গেলে হয়তো মৃত্যু হতে পারত। এমন সময় এগিয়ে এলেন খলিল মৌলবি নামের এক হোমিও চিকিৎসক। তাঁর ওষুধে অলৌকিক ভাবে সুস্থ হয়ে উঠলাম। সেই থেকে শরীরের সঙ্গে আমার যুদ্ধ লেগেই আছে, প্রত্যেক বারই আমার জিত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ মানেই হত বা আহত হওয়া। তাই প্রতিটি যুদ্ধে কম-বেশি আহত হয়েছি।

আব্বা আমাকে সাইকেলের বেবি সিটে বসিয়ে নিয়ে যেতেন আলিপুর। পুরাণ বাজার ছেড়েই রাস্তার দুপাশে ছিল বিস্তীর্ণ মাঠ – কখনও সবুজ, কখনও সোনালি। সেই নির্জন জায়গায় পৌঁছে তিনি কী বিড়বিড় করতেন আর ফুকফুক করে কাঁদতেন। চোখের জলের ছিটে এসে পড়ত আমার শরীরে। আমি বুঝতে পারতাম না, জিজ্ঞেস করে যে উত্তর পেতাম তা বোঝার বয়েস ছিল না আমার। বাড়িতে আমার বিছানা, থালা-বাটি সব আলাদা ছিল। খেলা-ধুলা করা নিষেধ ছিল। রোজ ডিম-মাংস খেতাম। একদিন সেই হাসপাতালে এলেন এক ডাক্তার – শাদা চামড়া, লম্বা শক্ত শরীর, বড় বড় আঙুল। বাবার কাছে জানলাম তাঁর নাম জীন বারোজ। আমাকে পরীক্ষা করে লাফ মেরে উঠে এত জোরে গর্জন করলেন যে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ‘লা মি না আ আ ....!’ এই আওয়াজে হাসপাতাল চত্বর যেন কেঁপে উঠল। ব্যস্ত হয়ে দরজার পাশে এসে হাজির হলেন ডা. লামিনা। তারপর দুজনে কী সব কথা হল। আবছা আবছা মনে পড়ে আব্বা আমাকে জড়িয়ে ধরে হেসেছিলেন তখন। বড় হয়ে আব্বার কাছে জানলাম ডা. জীন বারোজ সেদিন ডা. লামিনাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা কি টিবি রোগের লক্ষণ? চেহারা দেখে বোঝো না? এতদিন ধরে ছেলেটাকে কড়া ওষুধ দিয়েছ!!...’

এর পর সর্দি কাশি লেগেই থাকত। শীত এলে বাবা আমাকে এমনভাবে কাপড়ে মুড়ে দিতেন যে লোকে আমাকে এস্কিমো বলে বিদ্রূপ করত। নয় বছর বয়সে আমার হয়ে গেল এগজিমা। দুটি পা ফেঁটে পুঁজ রক্ত বের হত শীত এলে। অনেক ওষুধের পর একজন কবিরাজের চিকিৎসায় সেও কমল প্রায় তিন বছর পর। কিন্তু তখন এল শ্বাসকষ্ট। ফলে খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে খুব বাছ-বিচার চলত। মাস-দুমাস পর পর কী যন্ত্রণা। এরই মধ্যে একদিন ইসলামিক শিক্ষার এক প্রতিযোগিতামুলক পরীক্ষায় বসে ধরা পড়ল আমি চোখে কম দেখি। আমি দূরের বস্তু কম দেখতাম, কিন্তু ‘চালাকি’ করে কাউকে সেটা বুঝতে দিতাম না। ক্লাসে প্রথম বেঞ্চে বসতাম তাই কেউ বুঝতে পারত না। কিন্তু সেদিন হলের পেছন দিকে বসতে হয়েছিল। আমাদের মসজিদের ইমাম সেটা বুঝতে পেরে আমাকে আগে নিয়ে যান আর আমার বাড়িতে জানান। ধরা পড়ল আমার মায়োপিয়া ২.০। চশমা লাগাতে হল এগারো বছর বয়সে। আমার চশমা দেখে অনেকেই আঁতকে উঠতেন। ‘তুমি কি চশমা খুললে দেখতে পাও না?’ ‘কি হল চোখে?’ এ ধরণের অনেক প্রশ্ন আমাকে বড় কষ্ট দিত। এছাড়াও ঝগড়া হলে ছোট বড় অনেকেই গালি দিত ‘কানা’ বলে।

তেরো বছর বয়সে হাতে আসে এক যোগ ব্যায়ামের বই। সেটা পড়ে শুরু করে দিলাম যোগচর্চা। বদলে দিলাম খাদ্যাভ্যাস। শ্বাসকষ্ট থেকে রেহাই পেয়ে গেলাম এক বছরের মধ্যে। জীবনটাকে একটু ভোগ করার ইচ্ছে জাগল। কিন্তু প্রায়ই সর্দি-কাশি লেগেই থাকত। ডা. সুব্রত পাল প্রচুর অ্যান্টিবায়োটিক খাইয়েছেন। কমছে না দেখে আমি নিজে নিম-তুলসি-মধু মিশিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। অনেকটা কাজও হল। অনেক পরে জানলাম আমার এলার্জি আছে, ধুলো, বাক্সবন্দি কাপড়-কাগজ এসব নাকের কাছে গেলেই সমস্ত শ্বাসযন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে এখনও। ব্যাপারটা আগে জানলে হয়তো এত কষ্ট পেতে হত না।

ডা. চৌধুরীর কাছে আমার চোখের চিকিৎসা চলত। চশমার পাওয়ার বাড়তে থাকল। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বের হওয়ার কয়েকদিন আগে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে গিয়ে একটা ব্যাপার দেখে চিন্তায় পড়লাম। স্টাম্পগুলো মাঝখানে যেন ভাঙা মনে হল। এরপর যেদিকে তাকাই সব ভাঙা। বুঝলাম কিছু একটা সমস্যা আছে। পরদিন মনে হল সমস্যাটা নেই। আর কাউকে বললাম না। মাধ্যমিকের ফল যেদিন বের হল সেদিন আবার এই সমস্যা দেখা দিল। আমি জানতাম আমার রেজাল্ট কী হবে। তাই স্কুলে না গিয়ে ওরিয়েন্টাল হলে সিনেমা দেখতে গেলাম। দেখলাম পর্দাটা যেন ভাঙা। বাম চোখের দৃষ্টিশক্তি তুলনামূলক ভালো ছিল। সেই চোখেই ভাঙা দেখছি। পরদিন ডা. চৌধুরির কাছে এলাম। কয়েকদিন পরীক্ষার পর তিনি বললেন, রেটিনাল ডিটাচমেন্ট হয়েছে বাম চোখে। অপারেশন করতে হবে। যেতে হবে দূর মাদ্রাজে অবস্থিত শঙ্কর নেত্রালয়াতে। মাথায় যেন বাজ পড়ল সবার। কোন কলেজে কী বিষয় নিয়ে ভর্তি হবো এই পরিকল্পল্পনা নিয়ে সবাই যখন মশগুল, সবাই যখন আমাকে আর আব্বাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে সায়েন্স পড়লে ছেলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে, ঠিক তখনই ডাক্তার বললেন আমার পক্ষে পড়াশোনা আর হবেই না।

মাদ্রাজ যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হল। আব্বার বাইরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই কৃষ্ণপুরের আমার আত্মীয় তথা আব্বার সহকর্মী ফইজুল মামা আমাদের সঙ্গে যাবেন বলে স্থির হল। রেলের টিকিট বুক করা হল। ডাক্তারের পরামর্শে কমপ্লিট বেডরেস্ট। এরই মধ্যে ডাক্তার জানালেন একটা উপায় আছে, রোগ কমে যেতে পারে। আশায় বুক বেঁধে বিছানা পত্তর নিয়ে ভর্তি হলাম শিলচর মেডিকেল কলেজের আই অয়ার্ডে। আমার চোখ বেঁধে রেখে দেওয়া হল বিছানায়। দিনে কয়েকবার মেডিকেলের পড়ুয়ারা এসে বন্ধন খুলে ওটিতে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করত। মেয়েরাই বেশি উৎপাত করত। কেউ কেউ অযথা ঘেঁষাঘেঁষি করত, আমি বড়ই বিরক্তি বোধ করতাম। অবশ্য কারো কারো স্পর্শে জীবন ফিরে পেতাম। হিফজুর চাচা, আদিমা আন্টি দিনরাত লেগে থাকতেন। দশদিন এভাবে রাখার পর জানিয়ে দেওয়া হল মাদ্রাজ যেতেই হবে। পরে জানলাম এই দশদিন আমার চিকিৎসা হয়নি, ছাত্রছাত্রীদের গিনিপিগ ছিলাম আমি।

সেও এক অভিজ্ঞতা। চক্ষু বিভাগে তেমন গুরুতর রোগী নেই। বেশির ভাগ ছানির অপারেশন। করিমগঞ্জের এক রসিক বৃদ্ধ ছিলেন। জীবনের অপ্রাপ্তি নিয়ে এমন রসিকতা বোধ হয় সবাই করতে পারে না। আমাকে ডেকে বলতেন, ‘বুঝলায় নি নাতি, আমরার আর কদর নাই। সুন্দরী অখল তো পাল্লা, আমার বাড়ির এইনও আইন না। আইতাউ কিলা, পয়সা লাগে যেন।’ তিনি হাসপাতালের খাদ্য নিয়ে ব্যঙ্গ করতেন, ‘সরখারে সুয়াবি (সোয়াবিন) ইতা কিতা দি যেন বানাইল। অউ যেন গিলার রোজ। ভাতর লগে কামড় দিতে কচাৎ কচাৎ করে। গন লাগি গেছে।’ একদিন ভাত খেয়ে চরম তৃপ্তিতে ঘোষণা করলেন,’বুইচ্ছনিবা! আইজ এক কাম করছি। তলে নামিয়া হাগাই মরিছ লইয়া আইনছি। সরকারর ভাত আর সুয়াবি থালো লইয়া কান্দাবায় সাতগু হাগাই মরিছ থইছি। কামড়র লগে একোগু… হালার সুয়াবি… এবলাকু খাইতায় নায় আবার… ঝালে খালি ঠেলি ঠেলি হারার।‘ চক্ষু বিভাগের ওয়াশরুম তুলনামূলক ভাবে পরিষ্কার ছিল। আমার দাদা একদিন সেই ওয়াশরুম থেকে ফিরে বললেন, ‘এখানে পায়খানা করতে গেলে বমি করে ফিরতে হয়।’

তারপর একদিন অজানা দেশের উদ্দেশে পাড়ি দিলাম। বাস থেকে দুচোখ ভরে মেঘালয়ের পাহাড়, ঝরণা দেখলাম। ভাবলাম, আর এই চোখ দিয়ে এই রূপ দেখা হবে না বোধ হয়। গুয়াহাটি দেখে বিস্মিত হলাম, এতো লোক, এতো গাড়ি, অট্টালিকা। দিসপুরের যে আত্মীয়বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম তা এখন আর চেনাই যায় না। তখন ছিল মাটির গলিপথ, কচুরিপানায় ভরা বিস্তীর্ণ জলাভূমি। তারপর আরেক যাত্রা। এই প্রথম রেলভ্রমণ কোচিন এক্সপ্রেস চড়ে। গান গেয়ে, গানের দল গড়ে কামরায় কামরায় নিমন্ত্রণ খেয়ে কেটে গেল ৬০ ঘন্টা। প্লাটফর্ম পেরিয়ে মাদ্রাজ নগরী দেখে হতভম্ব। উঠলাম এস এম লজিং হাউসে। আব্বার কোনও অসুবিধে হল না। ইডলি, দোসা, সাম্বার গোগ্রাসে গিলছেন। আমি তো ফাঁপরে পড়লাম। কিছুই খেতে পারি না। পরিচয় হলো সোনাইর মিলন মামার সঙ্গে, সিনেমায় কাজ করতেন। আরো অনেকের সঙ্গে দেখা হল। এত আদর যত্ন সহযোগিতা মানুষ পরের জন্য করতেও পারে এই ব্যস্ত নগরিতে!

নেত্রালয়ে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করলাম। এক মহিলা জন্ম থেকে শুরু করে তখন পর্যন্ত অসুখ আর ওষুধের বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করলেন। অদ্ভুত সব যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা হল চোখ। ডাক্তার পি চাল্লা বললেন, দুচোখেই ডিটাচ হয়েছে কয়েক বছর আগে। বকাবকি করলেন, ‘দৃষ্টিশক্তি দ্রুত কমছে দেখেও তো ডাক্তারের বোঝা উচিত ছিল।’ যাই হোক বাম চোখ অপারেশন হল। ওটিতে যাওয়ার সময় গান গেয়ে গেয়ে ঢুকলাম। এক তামিল মহিলা হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন, কর্মীদের একজন আমার দিকে দেখিয়ে কী বলল মহিলাকে। বোধ হয় মহিলাকে সাহস দিল। আমি গর্বিত হয়ে একটু জোরে গান গাইলাম, ‘জিনা য়াহাঁ, মরনা য়াহাঁ’। বোধ হয় একটু আগে নেওয়া একটা ইঞ্জেকশনের প্রভাবও হতে পারে। তারপর একটা সেলাইন, ধীরে হাত থেকে শুরু করে মাথা পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে সব শেষ। জ্ঞান ফিরে আসার পর টের পেলাম আমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কী যন্ত্রণা আর অস্বস্তি। জানলাম আনেস্থেসিয়ার কারণে নাকি এসব হয়। তিনদিন পর চোখ খুলে দেওয়া হল। এলাম লজে, বেডরেস্ট। কিন্তু সেই ভাঙা দেখাটা থেকেই গেল। ডাক্তার বললেন, অপারেশন না হলে দৃষ্টিশক্তিই চলে যেত। আশ্বস্ত হলাম।

তারপর হল ডান চোখের অপারেশন। এই চোখটি এখন ভালো, কারণ বাম চোখে তো আমি ভাঙা দেখি। অপারেশন করলেন ডা. রবি। মনে পড়ে অপারেশন চলার সময় হঠাৎ আমার জ্ঞান ফিরে এসেছিল। সবাই চিৎকার করে আমাকে ঝাপটে ধরেছিল। বাড়ি ফিরে আসার পর কয়েক মাস পর আবার সমস্যা দেখা দিল। ডান চোখটাতে কিছু জ্বালা যন্ত্রণা হয়। গেলাম ডা. চৌধুরির কাছে। তিনি পরীক্ষা করে বললেন, বাকলটাতে চোখের পাতার ঘষা লেগে ক্ষত হয়ে গেছে। আবার গেলাম মাদ্রাজ। এবার বাকল রিমুভ করার জন্য ডান চোখে আবার অপারেশন করলেন ডা. মুনা পি ভেন্ডে। তিন মাস পর আবার যেতে বললেন। এরই মধ্যে সমস্যা দেখা দেওয়ায় ডা. চৌধুরির কাছে আবার গেলাম। তিনি শিলচর মেডিকেল কলেজের ওটিতে নিয়ে কীসব করলেন। পরে বললেন চোখের ক্ষতস্থানে একটা ফাঁক হয়ে গেছে, কিছুতেই জোড়া লাগছে না। নেত্রালয়াতে গেলে ডা. মুনা হেসে বললেন, এ আর জোড়া লাগবে না। প্লাস্টিক সার্জারি বা গ্যাস্প করা যেতে পারে। কিন্তু দরকার নেই। বছরে একবার পরীক্ষা করতে হবে। এবার এই চোখটাও আর ভালো রইল না। মনে হয় জ্ঞান ফিরে আসায় তড়িঘড়িতে কী একটা গণ্ডগোল হয়েছে, তবে সেটা আমার অনুমান মাত্র। এই কারণে লেন্স লাগানো সম্ভব নয়। লেজার তো আর সম্ভবই নয়।

একবার ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি ব্যায়াম করতে পারি? মাথা নেড়ে জানালেন পারব। আবার জিজ্ঞেস করলাম, খেলাঘুলা? পারবে। পড়াশোনা? তিনি একরকম রেগে গিয়ে বললেন, ‘ইউ ক্যান ডু এভরিথিং। হোয়াই আর ইউ আস্কিং? হু টল্ড ইউ দ্যাট?’ বললাম, আমাদের ওখানকার ডাক্তার বলেছেন। রেগে গিয়ে আমাকে ইংরাজিতে বললেন, ‘ওসব আজগুবি চিন্তা বন্ধ কর। কী হয়েছে তোমার যে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? তাহলে অপারেশন কেন করা হল?’ বহুদিন পর যেন মুক্তির স্বাদ পেলাম। এখনও আমি চলছি জীবনের জঙ্গল কেটে। এখনও আমি পড়ি, পড়াই, ব্যায়াম করি, কাজ করি। তবে জীবনের চাকাটাকে আগের গতি দিতে যেন দ্বিগুণ শক্তি দিতে হয়। কারণ দুর্ঘটনার পর গাড়ি মেরামত করে নিলেও আর আগের মত চলতে পারে না।


শনিবার, ২৩ মে, ২০২০

আতঙ্ক বড়ই সংক্রামক


আতঙ্ক বড়ই সংক্রামক

চোখের জলের হিন্দু-মুসলমান নেই।
দেশছাড়া হওয়ার চকচকে আতঙ্ক
গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।
তর্জনী আর কপোলে এখনও লেগে আছে
সদ্য মুছে ফেলা চোখের জলের অবশিষ্ট
আরেক ফোঁটা আগলে রেখেছে দু’চোখের পাতা।
সে চোখ তোমার , সে তোমার পরিচয়।
তোমার ধর্ম নেই, জাতি নেই।
ভগবান তোমার আবদার শুনে ভয় পায়,
সেও লাচার, ধনীর টাকা না পেলে সেও গৃহহীন হয়ে পড়ে।
আজকে যে ঘরে ঘুমাও তুমি,
যে জমির দখল রাখতে প্রতিবেশীর সাথে তোমার মোকদ্দমা চলে
সেই ঘর, সেই জমি, আগলে রাখা অলঙ্কার
নিমেষে নিঃশেষ হয়ে যাবার ভয় ঘুম ভাঙিয়ে দেয় তোমার।
যে মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা রেখেছো বিশ বছর মেয়াদে।
একদিন সেই কচি মেয়েটার জরায়ুর রক্তে
রাজপথ সিক্ত হয়ে যাবে সেই আশঙ্কায় জড়িয়ে ধরো তাকে।
জোয়ান ছেলেটার হাতে বই দেখে আঁতকে ওঠো তুমি
না জানি কবে কার নজরে পড়ে যায়।
পুরনো বাক্সটাকে জায়গা বদলে রাখো রোজ
তার ভেতরে রাখা কাগজ যেন হরিণীর মাংস,
লুকিয়ে রাখবে না হাতের কাছে রাখবে।
আতঙ্ক বড়ই সঙ্ক্রামক তুমি জানো
তবুও পারো না আট বছরের শিশুর চোখকে ফাঁকি দিতে
তার বইয়ের পাতায় তোমার আতঙ্ক ঘুর্ণিঝড় তোলে।

০৮-০১-২০২০

পার্থিব শিল্প

।। সাদিক মোহাম্মদ লস্কর ।।

তোমাকে বুঝতে বোঝাতে শেষ হয়ে গেল দিন।
নিজেকে বোঝানোর চেষ্টায় আমি ক্লান্তিহীন।
সন্ধ্যা হয়ে এল -- 
সব পাখি ঘরে ফিরে --
তুমিও তাই।

আমি আছি তারার নিচে
ঘাসের বিছানায়।
আজও শেখা হল না সেই সহজ পার্থিব শিল্প।

২৪-০৫-২০১৩

শুক্রবার, ৮ মে, ২০২০

তুমি আর সে

তুমি আর সে

বলেছিলাম প্রেম আর জীবনকে আলাদা
                                করে রাখতে।
তুমি বললে তখন প্রেম মানেই জীবন,
                                জীবন মানেই প্রেম।
এখন অদাহ্য প্রেম গুটি গুটি পায়ে
                                 রান্নাঘরে এসে
চুলা আর কড়াইয়ের মাঝখানে খুব দ্রুত
                                  ঢুকে যায়।
কখনো কখনো দেখি উঁকি মারে
                                  সব্জির বস্তা থেকে।
মেঘামার্টের উজ্জ্বল তাকে তাকে প্রেম
                                  লাফালাফি করে।
তার আঙ্গুলে রেখে শিশুটি চুষে নেয়
                                  আমাদের প্রেম।
এখন তো প্রেম থাকে বাচ্চার স্কুলের গেটে,
                                  পিল আর তিলের তেলে।
বলিরেখা দেখা গেছে ভালোবাসার
                                   চিন্তাগ্রস্ত মুখে।
কিন্তু সে তো আজো মাঝরাতে দুজনের
                                   ঘুমন্ত শরীরে
নরম চাহনি মাখা দেহহীন দেহের
                                    বাতাস লাগিয়ে যায়।

বাঁশকান্দি
০৩/১২/২০১৯

মিনারের নিচে


মিনারের নিচে

তুমি কোথা আছো হে প্রিয়?
গ্রহ নয়, নক্ষত্রে নয়, অন্য কোথাও।
আমি বসে আছি এই পৃথিবীতে
যে আজ শেষপ্রায় মিনারের ভিড়ে।
আমি জানি সব বালি ও পাথর –
সমস্ত পৃথিবীই মিনার হয়ে যাবে।
তাই বলি এসো তুমিই এখানে।
আমাদের ঘর ভাঙে আমাদেরই নিরলস পরিশ্রমে।
ঘুমহীন নয়নে দিয়ে যাও শীতল পরশ।
তার পর শুরু হবে আমাদের নতুন সকাল।

বাঁশকান্দি
০৬-০৪-২০২০

বুধবার, ৬ মে, ২০২০

করোনা, লক ডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি– ৪

করোনা, লক ডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি– ৪

সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
WhatsApp Image 2020-05-06 at 6.49.44 PM (1)
ম্যাজিক ড্রাইভারস এসোসিয়েশন তহবিল সংগ্রহ করে চালকদের পরিবারের কাছে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছিয়ে দিচ্ছে। ছবিঃ সাদিক মোহাম্মদ লস্কর।
অনেকটা পাল্টেছে পরিস্থিতি। করোনা যে আমাদের নিত্যশত্রু হয়েও নিত্যসঙ্গী হয়ে থাকবে আরো বহুদিন সেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। দেশে করোনা আক্রান্ত বা মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বাড়লেও জীবনের চাকা সচল করার চেষ্টা চলছে। এই অসময়ে মানুষের বদান্যতা ও মহানুভবতা ছিল লক্ষ করার মত। অনেক সমালোচনা সত্বেও বলতে হয় এই সময় কিছু সচ্ছল লোক যদি এগিয়ে না আসতেন তাহলে হয়তো উপোস করে মরতে হত অনেক মানুষকে। এখন অনেক নিঃস্ব পরিবার নাকি প্রার্থনা করছে যেন লকডাউন আরো দীর্ঘায়িত হয়। এদিকে পরিবারের মখে দুটি ভাত তুলে দিতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে এতদিনে তিলে তিলে গড়ে ওঠা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারগুলো। বছর পঁচিশের অবিবাহিত মেয়েদের বা জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারা বছর তিরিশের যুবকদের মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। পরিবারে অশান্তি দেখা দিয়েছে তাদের যারা সঠিকভাবে সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার শত চেষ্টার নিগড় ভেঙে বেরিয়ে যাচ্ছে পড়ুয়ারা।
সারা দিন কাজ করে শ’পাঁচেক রোজগার করে ব্যাগ ভরে নিয়ে আসা, বেসরকারি বিদ্যালয়ে সন্তানদের শিক্ষাদান, সম্মানের জীবনযাপন এই সব এখন আর সম্ভব নয়। ভাত আছে তো ডাল নেই, তেল নেই। গ্রামের কজন মানুষের মুরোদ আছে রোজ রোজ গাড়ি ভাড়া করার। যাত্রীবাহী গাড়িতে তিনজন যাত্রী নিয়ে সড়কে চলে বিকেলে কি পরিবারের মুখে ভাত দিতে পারবেন চালক? মিস্ত্রিরা এখন কাজ করতে পারেন ঠিকই। কিন্তু কতটুকু? ৬০০ টাকা দরে সিমেন্ট কিনে কজন বাড়ির কাজ করবেন এখন। সরকারি উন্নয়নমুলক কাজ প্রায় বন্ধ। তাও কম মানুষ লাগানোর ফরমান আছে। পান দোকান খুলেছে ঠিকই, কিন্তু দোকানির সদ্য স্পর্শ করা পান কিনে মুখে পুরে নির্ভয়ে চিবিয়ে নেবেন কজন? ক্ষৌরকর্মী এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতে পারেন। তা নিছক চুল ছাঁটানোর জন্য ঘরে বিপদ ডেকে আনবেন কজন? পার্লারের মহিলাটি বা ছোকরাটি তার সব আসবাব সঙ্গে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে পারবে? এমন আরো বহু পেশা আছে যা এখন আর ঠিক চলছে না। এই সব মানুষ হাত পাততে পারে না, তাকে দান করতেও কেমন কেমন লাগে।
REPORT THIS AD

অপ্রত্যাশিতভাবে লাভবান হয়েছেন একেবারে নিঃস্ব পরিবারগুলো। বলছি না যে রাতারাতি ধনী হয়ে গেছেন এরা। কিন্তু বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধর্না দিয়ে বাড়ি ফিরে আধপেটা থাকতে হচ্ছে না। বরং ত্রাণের ডাল-চাল বিক্রি করতেও পারছেন তারা। আর লাভবান হয়েছেন কৃষক। দুবারের অকাল বন্যায় ভাসিয়ে নেওয়ার পরও নদীর ধারে যারা তৃতীয়বার ফসল ফলিয়েছিলেন তারা লাভবান হয়েছেন। প্রথমটা একটু সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু বাইরের সব্জি না আসায় শেষমেষ অবশিষ্ট ফসল বিক্রি করেই পুষিয়ে নিয়েছেন তারা। ধান চাষ শুরু হতে এখনও বাকি। গালামাল, ওষুধ সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবসায়ীদের ফায়দা হয়েছে। তবে এই সব ফায়দা কচুপাতায় জলের মত সাময়িক। মিতব্যয়ী না হলে ঘোর অমাবস্যা অপেক্ষা করছে। নিম্নমধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেলে তার প্রভাব পড়বে উপরের মহলেও।
WhatsApp Image 2020-05-06 at 6.49.44 PM
বাজার শুরু হয়েছে। ক্রেতা বিক্রেতা বাজারে হাজির।  ছবিঃ সাদিক মোহাম্মদ লস্কর।
কৃষকদের আবার অনেক রকমফের আছে। যারা শুধু মরশুমে পরের ক্ষেতে চাষ করেন তাদের বছরের ভাত সঞ্চয়ে নেই। শুকনো মরশুমে শহরে বা গ্রামে জোগালির কাজ করে গতর খাটিয়ে পেট চলত তাদের। সব বন্ধ হয়ে গেছে। রেশনের চাল এসেছে, কিন্তু তা থেকেও নাকি এক কিলো করে বাট্টা দিতে হয় ডিলারকে। জিরো অ্যাকাউন্টের টাকা এসেছে ঠিকই। ছোট বাড়িটাতে কিছু সব্জি লাগাতে পারছেন না, কারণ এবারের রাস্তার কাজ করতে গিয়ে নিকাশি নালাটা বন্ধ করে দিয়েছেন মেম্বার। বাড়ির উঠোনে জল থৈ থৈ করবে আর কদিন পর। নদীর ধার ছাড়া বাকি জমিতে শুধু ধানই হয়। তাই যাদের নদীর ধারে জমি নেই তাদের তেল মশলা সব্জি কিনতে টান পড়ছে। সরকারের চোখ রাঙানোকে তুড়ি মেরে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হু হু করে।
দোকান খুলছে এবার, কিন্তু পালা করে। এতদিন পরে দোকান খুলে দেখা গেল কাপড়গুলোতে ইঁদুরের দল দুষ্টুমির কারুকার্য রেখে গেছে। প্রথমটা মাঝে মাঝে শাটার খুলে নাড়াচাড়া করেছিল কাপড় দোকানিরা। কিন্তু একবার খুলতে গিয়ে থানার দালালটা আড়চোখে চেয়েছিল মাত্র। মিনিট পাঁচেক পর দারোগাবাবু দলবল নিয়ে এসে সবার সামনে ঘাড় ধরে নিয়ে গেলেন একজনকে, মা-বোন সহ চোদ্দপুরুষ তুলে বিচ্ছিরি গালিগালাজ দিলেন, লকডাউনের আছিলায় লকআপে পুরে রাখলেন রাতভর, বাড়ির মানুষ এসে দারোগাবাবুকে খুশি করে সকালে তাকে উদ্ধার করলেন। এর পর আর দোকান খোলা হয়নি। এমন অনেক ঘটনা আছে। শাটারের ভিতর নষ্ট হয়েছে ব্যবসায়ীর মূলধন।
REPORT THIS AD

টিউশন, ছোটো ব্যবসা, বেসরকারি স্কুল বা বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করে সামান্য টাকা রোজগার করে নিজের পকেট মানি জোগাড় করে অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা। সাফল্যের পরিচিত গলিপথ ছেড়ে কখন স্বপ্নের বন্ধুর পথে পা রেখে হারিয়ে গেছে যারা তারা বাড়ির ঘ্যানঘ্যান থেকে একটু সরে থাকতে চায়। কিন্তু এখন মা-বাবার মুখের বিরক্তি, হতাশা কিংবা অন্যদের উপেক্ষা ঘরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে বার বার তার মাথায় এসে আঘাত হানে। ফ্যান, উড়নি আর গলার মধ্যে যেন কী একটা আকর্ষণ সে টের পায়। তবুও এসব সরিয়ে রাখে সে। নিজেকে সে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এই প্রবল আকর্ষণ-বিকর্ষণে তার মনটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়।
এখানকার বেশিরভাগ মানুষের কাছে আছে শিক্ষার দুটি উপায়। এক, সরকারি স্কুলে পাঠাও আর অনায়াসে শূন্য ঝুলি নিয়ে লাফ মেরে এগিয়ে যাও। দুই, বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করো, টাকা খরচ কর আর দুবেলা টিউশনিতে পাঠাও। সন্তানের পাশে দুঘন্টা বসার সময় ছিল না অভিভাবকের। এখন সময় থেকেও নেই। কারণ এ দায়িত্ব তো তাদের নয় বলেই ভাবেন তারা। তাই হোয়াটসআপ, জুম, টিভি, রেডিও কোনকিছুই শিক্ষার সেই ধারাকে ধরে রাখতে পারছে না। সরকারি স্কুলে দশ শতাংশ পড়ুয়া এই সুযোগ নিচ্ছে আর বেসরকারি স্কুলে তার বিপরীত পরিসংখ্যান। কিন্তু এই পড়ুয়ারাও অভিভাবকের আঙুল ছাড়িয়ে ইন্টারনেটের মোহময় বিচিত্র জগতে হাতড়ে বেড়াচ্ছে আর নানা নিষিদ্ধ ফলে হাত পড়ছে তার। ফলে ‘গুড মর্নিং’ ছাড়া আর কিছুই তার তরফ থেকে না পেয়ে হতাশ হয়ে যান শিক্ষক।
ভেবেছিলাম এইবার বোধ হয় নড়েচড়ে বসবে সরকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদিতে জোর দেবে। কিন্তু কই? সরকারি স্কুলের অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেসব নির্মাণ কাজ অর্ধসমাপ্ত ছিল সেগুলোও অনির্দিষ্ট কালের জন্য আটকে রইল। পড়ুয়াদের কষ্ট বেড়েই গেলো। ক্রমশ সংকোচিত হয়ে আসা কর্মসংস্থান হঠাৎ যেন চুপসে গেল। ফলে যুবসমাজের হতাশা মারাত্মক রূপ নিতে পারে। এখন সরকারের উচিত সামরিক বা অন্যান্য কম প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় কমিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ইত্যাদি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা। কর্পোরেটদের ঋণ মকুব না করে বাড়তি কর চাপানো। রাষ্ট্রসংঘ সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এখন বলিষ্ট ভুমিকা নিয়ে সীমাসুরক্ষার গুরুত্ব কমিয়ে আনতেও পারে। সংঘ, সংস্থা ইত্যাদির উচিত সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণে বাধ্য করা, অনুদানের অপেক্ষা না করে সম্পদের সদ্ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করা। এক কথায় সর্বস্তরের মানুষকে স্ফটিক স্বচ্ছ মন নিয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। দায়িত্বের বাইরে গিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দেওয়ার যে ট্রেন্ড চলছে তাকে উৎসাহিত করতে হবে। তবে শুধু পয়সা খরচ করলে চলবে না, প্রত্যেককেই নিজ নিজ দক্ষতা ও উদ্ভাবনী শক্তির প্রয়োগ করতে হবে।

করোনা, লকডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি –৩

করোনা, লকডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি –৩


সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
জীবনকে ছন্দে ফেরানোর চেষ্টায়। নিজের ঘর মেরামতির উদ্যোগ। ছবিঃ সাদিক মোহাম্মদ লস্কর।
জীবনকে ছন্দে ফেরানোর চেষ্টায়। নিজের ঘর মেরামতির উদ্যোগ। ছবিঃ সাদিক মোহাম্মদ লস্কর।
REPORT THIS AD

মৃত্যুর স্রোতস্বিনীর ভয়ে জীবনের চাকা কতদিন থামিয়ে রাখা যায়! জীবন থেমে গেলেই তো মৃত্যু আসে সেই গতির ধারবাহিকতা বজায় রাখতে। তাই সেই নদীর ভয়ঙ্কর স্রোত উপেক্ষা করেও সেতু নির্মাণ করতে হয়। কিন্তু যখন প্লাবন আসে আমদের ঘরেও সেই স্রোত আর ঢেউ জোর ধাক্কা দিয়ে যায়। তখন সেতু নির্মাণের কথা কেউ ভাবতেও পারে না। সে চলে যাওয়ার সময় ছেড়ে যায় নোংরা কাদা আর আবর্জনার রাশি। সেই সব পরিষ্কার করে তবেই বাস্তুকারের মাথায় আসে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা। করোনার হানা পৃথিবীময় মহাপ্লাবনের মতোই; অনেকটা নুহ নবীর সময়কার প্লাবনের মতোই পৃথিবীময়।
কাদা আর আবর্জনার মধ্যেই আবার শুরু হয়েছে চলাচল। কিন্তু ধীর লয়ে। কিস্তি কিস্তি করে জীবনের পাপড়ি উন্মোচিত হচ্ছে। একটুকুন ছড়িয়ে দিলেই কোথা থেকে এসে ঝাপটা মেরে বসবে ভয়ঙ্কর মৃত্যু। এই তো আশেপাশেই সে ঘাপটি মেরে বসে আছে। তাই সাবধান; সাবধানের মার নেই। চিকিৎসা, অত্যাবশ্যক পণ্য, প্রশাসন ইত্যাদির সাথে এবার আংশিক মুক্ত হলো খাদ্য উৎপাদন ও বিক্রয় ব্যবস্থা, নির্মাণ, লরি মেরামত ইত্যাদি। সরকারি কার্যালয়ে পালা করে হাজিরা দেবেন কর্মচারীরা। জমায়েত বন্ধ থাকবে। শহরের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্নই থাকবে আরো বহুদিন।
আমাদের জীবন তো শহরমুখী হয়ে গেছিল। হঠাৎ করে সেই পথ বন্ধ হয়ে গেল। যাত্রীবাহী গাড়ি চালিয়ে যারা রোজগার করত তারা এখন আমাদের চোখের সামনেই কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। এরকম আরও অনেক কর্মক্ষেত্র অচল হয়ে পড়ছে। এদের জন্য জন্য বিকল্প কী? বরাক উপত্যকায় সেই অর্থে কৃষি নেই। এখানে সারা বছর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে না চাষির পেঠ ভরে না জমি মালিকের। ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যাওয়া কৃষিজমির মালিকরা এখন আর জমিদার নন। সরকারি উন্নয়ন কাগজে আর রাঘব বোয়ালদের পেটে। কোটি টাকার জলসিঞ্চন প্রকল্প থেকে দুই ফোঁটা জলের ছিটেও বের হয়না। মানুষের অনৈতিক দাবি মেটাতে টিলাগুলোর দেহ বিসর্জন হয়েছে জলাশয়ে। আর জলাশয় ভরে ঘর উঠেছে। তাই খাদ্য উৎপাদনের সব রাস্তাই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে প্রায় শূন্যহাতে ঘরে ফিরছে হায়দরাবাদ, বাঙ্গালোর, কাতার, দুবাই থেকে কাতারে কাতারে যুবকের দল। তাদের নিয়োগকারী উদ্যোগপতিদের অনেকেই এই বাড়তি বোঝা নানা অজুহাতে ঝেড়ে ফেলতে চাইছিল, এখন সে পথ পরিষ্কার হয়ে গেল। কম শ্রমিক দিয়ে বেশি মুনাফা অর্জনের চেষ্টাই করবে তারা। আসলে এদের তো কোনও লোকসান নেই, উদ্বৃত্ত মুনাফায় ঘাটতি হবে মাত্র। এই সুযোগে কোটি কোটি টাকার কর মকুব করার ধান্ধা করবে এরা। ফলে সস্তা শ্রমিকের ছড়াছড়ি হবে বিশ্বময়। আমাদের বরাকেও এর ঢেউ আছড়ে পড়বে।
WhatsApp Image 2020-04-21 at 11.26.54 AM
হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোর্স করে সুরাট গিয়ে চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল মুন বড়ভূইয়ার। এখন তো আর বসে থাকতে পারে না সে। ছবিঃ সাদিক মোহাম্মদ লস্কর।
এরকম একটা পরিস্থিতিতে আবার সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে পুনরুজ্জীবিত করা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু প্রয়োজন সব পারে। সময় বলে দেবে ঠিকই; কিন্তু সে অপেক্ষা না করে সময় থাকতে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষি, জলসেচ ইত্যদি বিভাগের যা গেছে তা নিয়ে আন্দোলন করার সময় এখন নয়। কিন্তু যা অবশিষ্ট আছে তা নিয়ে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায় সেই পন্থা ঠিক করতে হবে। এসব বিভাগের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের এখন কাগজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে মাঠে নামতে হবে। বর্ষার মরশুমে ধান সহ অন্যান্য শাকসব্জি কীভাবে ফলানো যায় সে চেষ্টা করতে হবে। বাঁধ নির্মাণের নামে রাস্তা নির্মাণ আর নয়। বরং যেখানে বাঁধ দরকার সেখানেই তা নির্মাণ করতে হবে। জবরদখল হওয়া জলাশয় মুক্ত করে মৎস্যচাষের উপযোগী করে তুলতে হবে। জল নিষ্কাশন ও সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে এমজিএনরেগার মাধ্যমে।
যারা কৃষির সঙ্গে মোটেই পরিচিত নয় তারা এখন এক বিপন্ন প্রজাতির মত। এদের কথা আলাদা করে ভাবতে হবে। স্বল্পকালীন ব্যবস্থাপনা হিসেবে এদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যবসা করার সুযোগ করে দিতে হবে। এছাড়াও এদের বড় অংশ যেহেতু শিক্ষিত তাই তাদের দক্ষ শ্রমিক, উদ্যোগী বা ব্যবস্থাপক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

পুর্ব প্রকাশিত