বুধবার, ৬ মে, ২০২০

করোনা, লকডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি –২

করোনা, লকডাউন ও গ্রাম বরাকের ছবি –২


সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
WhatsApp Image 2020-04-18 at 12.49.43 AM
ক্ষুধার ধর্ম নেই। অ্যাকাউন্টের টাকা দিয়ে খাবার কিনে বাড়ি ফিরছেন ভিন ধর্মী দুই মহিলা। ছবি: সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
লকডাউনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হল। না, এখনও জয় করা গেল না এই অদৃশ্য শত্রুকে। তবে মনে হয় একটু দুর্বল হয়েছে। যদি হয়, তবে কারণটা কী তাও জানা গেল না। হয়তো আমাদের অপুষ্টি জর্জর শরীর ততটুকু অপারগ নয়। হয়তো দূষিত জল ও বাতাস সেবন করা এই শরীর দুর্বল জীবাণুকে প্রতিহত করে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। হয়তো চারদিকে জমে থাকা আবর্জনার ভিড় আর জীবাণুর আঁতুড়ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে অভ্যাস হয়ে গেছে অনেকের। হয়তো নানা ধরণের টিকা আমাদের শরীরে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করে রেখেছে। বা হয়তো অন্য কিছু। হয়তো আমরা এইভাবে বয়ে ফিরছি জীবাণুর দল। আর তার জেরে হয়তো ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে এখনও। হঠাৎ করে সব অহঙ্কার ধুলির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে হাহাকার আর আর্তনাদে ভরে যেতে পারে আমাদের চারপাশ। এই পরিস্থিতি যেন কখনও না আসে এই কামনা করি।
REPORT THIS AD

কিন্তু আমাদের চাওয়ায় কি সব ঠিক হয়ে যায়? আমরা চাইলেই কি ছেলেগুলো চক্কর মারা ছেড়ে দেবে? আমরা চাইলেই কি অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া ৫০০ টাকা তুলতে মহিলাদের ভিড় এক মিটার দুরত্ব বজায় রাখতে পারবে? আমরা চাইলেই কি মাছ বেচতে আসা লোকটার চারপাশের মানুষগুলোর রাক্ষুসে ভাব উবে যাবে? আমরা চাইলেই কি রেশনের দোকানের সামনের লক্ষণরেখার বাইরে বের হবে না সবজান্তা নির্ভীক লোকটার চরণযুগল? আমরা চাইলেই কি মৃত্যুঞ্জয়ী সংবাদকর্তার মুখ ভয় দেখানো ছেড়ে দেবে? আমরা চাইলেই কি সোশ্যাল মিডিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মহাজ্ঞানী লোকটা কালো দাঁতের ফাঁক দিয়ে দেয়ালে পিক ফেলা বন্ধ করে দেবে? না, হবে না। তাই ভয় হয়। কারণ আমি বা আমার মত অনেকেই জানি না আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটুকু। জানলেও বেপরোয়া হওয়ার সাহস রাখিনা, কারণ আমাদের বাড়িতে শিশু-বৃদ্ধ-অসুস্থ মানুষ আছেন। বাড়িতে না থাকলেও পাশের ঘরে আছেন।
পাঁচশ’ টাকার জন্যে বের হওয়া মহিলার কি মৃত্যুভয় নেই? আলবাৎ আছে। কিন্তু সন্তানের ফ্যাকাশে মুখ চোখের আড়াল করতেই হোক বা আশঙ্কায় টানটান নিজের চেহারাটা সন্তানের চোখের আড়াল করতেই হোক সে বেরিয়ে আসে। মন আনছান করে তার, গণ্ডির ভিতর থেকে তার পা ছিটকে বেরিয়ে আসে কখন সে টেরই পায় না। নির্ভীক লোকটা কি সত্যিই নির্ভীক? সে কি সত্যিই পরমেশ্বরের কাছে তার জীবনের ভার সঁপে দিয়েছে? এমনটা হলে তো সে বসে বসে ঘরের চাল ফেড়ে অন্ন বর্ষণের অপেক্ষায় থাকত। আসলে নিজের অসহায় অবস্থাকে সে নিজেই যেন উপহাস করে। যত্রতত্র পিক-থুথু ফেলা লোকটা কি সত্যিই আত্মবিশ্বাসী? না, ভার্চুয়াল জগতে নিজস্ব পরিসরকেই সে জগত বলে মনে করে। সেই একপেশে জ্ঞান আর বোকা বাক্সে ছড়ানো ঘৃণার জবাবেই সে থুথু ফেলে এখানে ওখানে। আর মাছের ক্রেতা-বিক্রেতা? মদ্রিখালে মাছ ধরতে গিয়ে জলদেবতা এই দুর্যোগে তাকে যে আইড় মাছ উপহার দিলেন তার ক্রেতা প্রত্যন্ত মদ্রিপার গ্রামে নেই, তাই সে বুকের দুরুদুরু চাপা দিতে দিতে বেরিয়ে আসে বড় দরকারি হাজার টাকার লোভে। আর ঠিক তখনই মৎস্যখেকো লোকগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারাও ঘরে আবদ্ধ পরিবারের সদস্যদের চমকে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারে না। বিনা কাজে ব্যাঙ্কে টাকা আসছে, তাই মাছ না খেয়ে মরতে যাবো কেন – এই ভাবনাও কাজ করে কিছুটা। আর দুরন্ত ছোকরাদের কী? চিরদিনই তো তাদের শাসন করতে গিয়ে নিজেদের সেই সময়টা ভুলে যায় বুড়োর দল। তাদের বুকের হাহাকারটা কে বোঝে! তাদের সঙ্গে কি দুমিনিট একান্তে আলাপ করে ঘরের লোক? অবশ্যই না। আর সংবাদ? যে কুকথার বাজার দীর্ঘদিনে গড়ে উঠেছে তা কি ভালো কথায় চলতে শুরু করবে হঠাৎ?
WhatsApp Image 2020-04-18 at 12.49.41 AM
চয়ন পাল শেষ পর্যন্ত কিছু সব্জি কিনে এনে ঘরের বারান্দায় বসে বিক্রি করছেন। ছবি: সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
বাড়িতে অকারণ উৎপাত শুরু করে দিয়েছে শিশুরা। ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যাওয়া বাড়িতে কি আর জায়গা আছে? ঘেন্না ধরে যায় তাদের। সকাল সকাল কাপড় পরে, চুল বেঁধে, পিঠে বইয়ের বোঝা নিয়ে যাওয়াতেও বোধ হয় পরিবর্তনের সুখ ছিল। একমাস হয়ে গেল বন্ধুদের দেখা নেই। ভাই-বোন-মা-বাবাতে সীমাবদ্ধ জীবন আর ভাল্লাগে না। কী হয়ে গেল হঠাৎ! বাবার চোখে চকচকে ভাবটা নেই, হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ঘোলা চোখে। মা যেন আগের মত নেই। সেই দুরত্ব কি সহ্য করা যায়? কবে খুলবে স্কুল, সেই প্রশ্নের জবাব কারো কাছে নেই। বাবা বোধ হয় ভিক্ষেও করে আজকাল – কারা এসে চাল-ডাল দিয়ে যায়, পয়সা নেয় না। এইসব হাজার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না বাচ্চারা। তাই তারা সব গণ্ডি ডিঙিয়ে বেরিয়ে পড়ে খেলার মাঠে। আর যারা পারে না তারা অকারণ উৎপাত করার অপরাধে মার খায় খিটখিটে মেজাজের অভিভাবকদের হাতে।
অনলাইন ক্লাস শুরু করেছে কিছু স্কুল। এতে পড়ুয়াদের সঙ্গে স্কুলের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন না হয়ে এক সূত্র রক্ষা হয়। এসব চলছে হোয়াটসঅ্যাপে নিতান্ত আনকোরা আন্দাজে। বেসরকারি স্কুলের এই উদ্যোগকে অনেকে সন্দেহের নজরে দেখছেন। অনেক অভিভাভক কর্মহীন হয়ে মোবাইলটি নিয়ে একটু ডুবে থাকবেন ভাবছেন, তো শিশুটি এসে সেই মোবাইলটি চেয়ে বসে, আর তখনই মেজাজ হারিয়ে বসেন অভিভাবক। শিক্ষকদের ভয়েস নোট পাঠিয়ে কড়া বার্তাও দেন অনেকে। অনেক বেসরকারি স্কুল সে চেষ্টাও করেনি। মন্দার বাজারে বেসরকারি স্কুলগুলো বেতন দেবে কী করে সেও এক সমস্যা। তাই অনলাইন ক্লাসের ঝামেলা বাড়ানোর ঝুঁকি নিতে চাইছেন না অনেকেই। সরকারি বিদ্যালয়ের চিত্র অন্যরকম। স্কুল খোলা থাকলেও যেখানে শিক্ষা দান বা গ্রহণে কোনও পক্ষেরই কোনও আগ্রহ থাকে না, সেখানে স্কুল বন্ধ থাকা অবস্থায় এই অখণ্ড অবসর বিনোদনের সুযোগ কে হাতছাড়া করে! ফলে সরকারের নির্দেশ যেমন দায়সারা, তেমনি শিক্ষকরাও যেনতেন প্রকারে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিতেই ব্যস্ত। পরিচালন সমিতি তো এসব বোঝেই না। যারা বোঝে তাদের হাতে তথ্য নেই। অ্যাডমিশন রেজিষ্টার নেই স্কুলে, থাকলেও সেখানে কোনও বর্ণনা নেই। আর অভিভাভক তো আর এসব সাত পাঁচে নেই। স্মার্ট ফোনই বা কজনের ঘরে আছে? সব গ্রামে ইন্টারনেট পরিষেবাও পৌঁছায়নি। তাই পড়াশোনা যে লাটে উঠেছে সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সব কিছু ছন্দে ফিরতে আরও কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।
সুখের শিখরে বসে ক্ষমতার অলিন্দে থাকা লোকগুলো মাটির খবর রাখে না। তারা ভাবে টাকা দিলাম, খাবার দিলাম, তার পরও ঘরে বসে থাকে না মূর্খের দল। পাঁচশ টাকায় কদিন যায়? শুধু কি খাবার? করোনা ছাড়া আর সব রোগ কি ত্রিভুবন ছেড়ে পালিয়ে গেছে? ওষুধ চাই, ঘর মেরামতের খরচ চাই, বস্ত্র চাই, মোবাইল রিচার্জ চাই, বই-খাতা চাই। পাঁচটা আলু, দুশ গ্রাম তেল, দু কিলো চাল, এক পোয়া ডাল দিয়ে ফটো তুলে যারা প্রচার করেন তারা বোঝেন না যে এই সামগ্রি দুবেলার ক্ষুধার যোগান নয়। এটা শেষ হওয়ার পরেই শুরু হয় জীবন সংগ্রাম। কারণ খাদ্যদ্রব্যের দাম এখন আকাশছোঁয়া। সরকার এসব নিয়ন্ত্রণে অপারগ।
WhatsApp Image 2020-04-18 at 12.49.42 AM
নিজের কাজ নেই। অভিজিৎ দেব বাবার পুরনো দোকানে আবার পসরা সাজানোর চেষ্টায়। শহর থেকে চড়া দামে পণ্য কেনা আর আনা বড়ো কঠিন। ছবি: সাদিক মোহাম্মদ লস্কর
অনেকেই দেখেন অসহায় মানুষকে। অসহায় মানে বিধবা মহিলা, রুগ্ন-অক্ষম লোক, ভিক্ষাবৃত্তির উপর নির্ভরশীল পরিবার ইত্যাদি। কিন্তু এখন একটা নতুন শ্রেণী অসহায় শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। যাত্রীবাহী গাড়ির চালক, পান দোকানি, পুচকাওয়ালা, দোকানের কর্মচারি, রাজমিস্ত্রি – এদের চুলার খবর কে রাখে। লাইনে দাঁড়িয়ে হাত পেতে নিতে পারে না তারা। তাই এঘর ওঘর করে বেড়ায়। আগে জানলে হয়তো অন্য উপায় করে রাখত। প্রথমে হিমালয় পাহাড়ের আড়ালে, তারপর সাগরের ওপারে ছিল মানুষের দুঃখ। তাই দেখা গেল না, আর কেউ সতর্ক করেও দেয়নি।
এখন হবে কী? তাসের ঘরের মত নিচের তলা থেকে ধীরে ধীরে ধসে পড়বে আমাদের অর্থব্যবস্থা। অনেক কিছুই আর আগের মতো ফিরে আসতে পারবে না। বহুদিন রাস্তায় চলবে না যাত্রীবাহী গাড়ি। মানুষের স্বাভাবিক যাতায়াত ব্যাহত হয়ে পড়বে। ঘৃণা এই আছিলায় ছড়িয়ে পড়বে গ্রামে গঞ্জে। বহু মানুষ একঘরে হয়ে যাবেন সতর্কতার অজুহাতে। অস্পৃশ্যতা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এই সব কিছুর জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে সবাইকে। সরকার মানুষের কথা ভাবে না। তার ভিতর চলে রাজনীতির নানা জটিল অঙ্ক। তাই সচেতন মানুষকেই এ নিয়ে ভাবতে হবে, পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে। গণ হিস্টিরিয়া থেকে কীভাবে সমাজকে বাঁচাতে হবে তা ঠিক করতে হবে। নতুবা উন্মাদের দেশে পাগলা গারদের মতো বাস করতে হবে। এই বিপদে আন্তর্জাতিক সহায়তাও আশা করা যায় না।

পুর্ব প্রকাশিত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন