হাঁটতে হাঁটতে
কতটুকু যাওয়া যায়? যেখানে গিয়ে পা আর চলেনা সেখান পর্যন্ত? নাকি ফিরে আসার শক্তি
অনুমান করেই থেমে যাওয়া? মনে মনে প্রশ্নটা করে চলছিল সে। অনেক সময় নিজের শক্তি
অনুমান করা যায়না। ক্লান্তির সীমারেখা ঠিক কোনখানে দ্রাঘিমারেখার মত অপেক্ষা করছে,
তা বোঝা মুশকিল। এই রেখার উপর পা রেখেও ঠাহর করা যায়না। হঠাৎ চারপাশে চলন্ত জীবনের
গতি দেখে অভিভূত হতে হয়। কিছুক্ষণ পর সম্বিত ফিরে পেয়ে নিজের আগের গতির পরিমাপ করে
মনে হয় কখন পেরিয়ে এসেছি সেই সীমারেখাটি। তখন জিরিয়ে নিতে গেলে মনে ভয় আসে যদি একা
হয়ে যাই। এমন অনেক ভাবনা তার মনে আসছিল। আর ভেবে ভেবে ক্লান্তি ঝেড়ে এগিয়ে যাওয়ার
প্রাণপণ চেষ্টা করছিল সে।
তবুও সে একা।
কারণ তার মত কেউ নেই। বাড়ি ফিরলে হাতের দিকে কতকগুলো চোখ চাদ-সূর্যের মত চেয়ে
থাকে। ছোট্টবেলার সেই চাঁদ যে তার পিছু ধাওয়া করত। বাড়ির বাইরেও তাই। কেন এত
প্রত্যাশা ভিড় করে চারপাশে! আসক্তি আর
বিরক্তির পাটিগণিত তাকে যেন ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল। যেমন তেল ফুরনো গাড়ি।
ছোট্টবেলায় বাবার
হাত ধরে বাজার যাওয়ার সময় কাকুরা প্রশ্ন করত ‘বড় হয়ে কী হবে?’ হওয়াটা ঠিক কী তখন
বুঝে ওঠার মত বুদ্ধি ছিলনা তার। ধীরে ধীরে পৃথিবীর সবচাইতে বড় পদটিতে অধিষ্ঠিত হওয়ার
সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠল। এমন পদ যে অনেক আছে তাও আরো কিছু পরে আবিষ্কার করল সে। অজানা
আগ্রহ তাকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল। তারপর ধরা পড়ল শরীরের দুর্বোধ্য অবাধ্যতা।
শরীরের রসায়নে মনের বিচিত্র উঁকিঝুঁকি। আর তাকে ধরতে গিয়ে অপ্রত্যাশিত অজস্র
আশ্চর্য আবিষ্কার। একদিন হঠাৎ মনে হল সব ভুল। আর তখন থেকেই অঙ্ক কষে চলা। সঙ্কুচিত
হয়ে গেল স্বপ্নের পরিসর। চাহিদার ভিড় ঠেলে স্বপ্নের দুর্বল শরীর নিজের জন্য জায়গা
করে নিতে পারেনা।
যাত্রীবাহী
গাড়িতে চড়ে অফিসে যাতায়াত। কোনো যাত্রায় মুখ ভার করা অপরিচিত ও অপেক্ষাকৃত বড়লোক
সহযাত্রীদের অনুকরণ করে তাদের চেয়ে বেশি গম্ভীর ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করে সে।
আবার কখনো গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ার পথে নতুন সৌন্দর্য আবিষ্কার করার ধ্যানে মগ্ন হয়
সে। তবে সেই ধ্যানে সিদ্ধিলাভ হয়না কখনো। রোজ তো আর প্রকৃতি নতুন রূপে সাধারণ
মানুষের কাছে আসেনা। কখনো বা জিনিষপত্রের দাম, স্থানীয় রাজনীতির পরিবর্তনের
প্রয়োজন ইত্যাদি বিষয়ে জোরদার বক্তব্য তুলে ধরেন কোনো সহযাত্রী। মূল্যবৃদ্ধির
আলোচনায় কখনো সে মন্তব্যও করে। কিন্তু রাজনীতি সম্বন্ধে আলোচনায় সে সাবধানে সমর্থন
করে শুধু। পরিবর্তন আদৌ জরুরি কিনা, এমনটা কখনো হয় কিনা এসব চিন্তা করে সে কুল
পায়না। তার অস্বস্তি বোধ হয়। চতুর্থ শ্রেণির কর্মী সে। কলেজ ছাত্রীদের চোখে চোখ পড়লেও
ফিরিয়ে নেয় সে। মনে পড়ে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের প্রতি দায়িত্ববোধের কথা। মনে পড়ে নিজের
বয়স, সম্মান ইত্যাদির কথা। যদিও এমনটা করতে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়না তার।
অফিসে ঢুকতেই
উদরপুর্তি হাঁক দেন। ফাইল অথবা চা নিয়ে সে হাজির হয়। কখন কী দরকার তা বুঝতে পারে সে। তবে অতিথি এলে
খালি হাতেই হাজির হয় সে। সাহেবের নাম কী চক্রবর্তী। কিন্তু খাই খাই স্বভাবের জন্য
তার এই জনপ্রিয় নাম। নামটা খুব সম্ভবত তারই দেওয়া। এখন সে বিশ্বাসই করতে পারেনা যে
তার পক্ষে এমন নামকরণ সম্ভব। উদরপূর্তির কাছে সে এখন খুব প্রিয়। কারণ সে এখন তারই
ভাবশিষ্য। সাহেবের নির্দেশ ছাড়া ফাইল সে বের করেনা। নিতান্ত বিপদগ্রস্ত মানুষকে
ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। পকেটের অর্থ থেকে দক্ষিণা দিতে হয় তাদের। কিছু মানুষ
স্বার্থ বা পরার্থ হাসিল করতেও দক্ষিণা অর্পণ করেন। মাঝে মাঝে কিছু ত্যাঁদড় এসে
যন্ত্রণা দেয়। এদের কয়েক রোজ চক্কর কাটিয়ে দিলেই হল। এসবে ঝুঁকি আছে। তাই সাহেবকে
এক তৃতীয়াংশ ভাগ দেয় সে। বিকেলে বন্ধ ঘরে ভাগবাটোয়ারা হয়। অফিসের সবাই সিস্টেমের
ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে গা খালাস করে। সে ওসব করেনা। তবে একটু দান, উপাসনা এসব সে করে।
বিধাতা যে মানবজাতিকে ক্ষমা করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন এবং সামান্য তোষামোদের
বিনিময়ে গুরুতর পাপ তিনি ক্ষমা করতে পারেন এই যুক্তি সে হাস্যকর মনে করেনা এখন।
বাড়ি ফিরলে সংসার
নিয়ে ব্যস্ত স্ত্রীর মুখ দেখতে হয়। শুধু খাওয়া ও ঘর গোছানোর কাজে জীবনের সবটুকু
সময় যে মেয়ে নিঃশেষ করে দিতে পারে তার দিকে প্রশংসাসুচক দৃষ্টি না ফেলে কোন পুরুষ।
ঘরে এসে কোনকিছু অপরিপাটি দেখতে হয়না। চাওয়ার আগেই হাজির হয়ে যায় ক্ষুধা-তৃষ্ণার
নিবারক। ছেলেমেয়েও বড় হচ্ছে। দায়-দায়িত্ব তো সামলাতেই হয়। এমন ব্যস্ত স্ত্রীর
সামনে প্রেম না দেখিয়ে ব্যস্ততার প্রদর্শন করাই ভালো। তবে এসব যে খুব একটা
পরিকল্পনামাফিক হয় তা কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে হৃদয় নামক অপদার্থটির
উপস্থিতিও টের পাওয়া যায়।
‘কী দেখছ?
টিফিনটা এনেছ?’ একটু যেন লজ্জা পেয়েই চিরুনিটা পকেটে পুরে টিফিনটা হাতে নিল সে।
স্ত্রী একটু বিস্মিত হলেন ঠিক। কিন্তু খুশি হলেননা। স্বামীর পালিয়ে যাওয়াটা তার নজর এড়িয়ে
গেলনা। দুই ছেলে তাদের। ছোট ছেলের বয়স পাঁচ হয়ে গেছে। সবাই চলে গেলে শাশুড়িকে
সঙ্গী করে টিভি সিরিয়ালটা দেখে নেয় রোশন। বিয়ের পর এখানেই তার পৃথিবী দর্শন।
বিকেলে সবাই বসে
হিসাব করছেন। সাহেবের কাছে সে ধরা পড়ে যায়। পল্টু একটা মীমাংসা করে দিল। তবে
সাহেবের ধমক খেতে হল ‘বাবু হঠাত দয়ার সাগর হয়ে গেলেন... গরিব মানুষটির কাছে ঘুষ
চাইতে পারছিলেননা...’ সে নিঃশব্দে জবাব দিল, ‘একটা গাড়ি পেলে বাড়ি ফিরতে মন চায়
সবার’। সত্যিই সে বাড়ি ফিরতে চাইছিল।
বাসটা এসে গেছে।
কিন্তু জানলায় একটা হাত না দেখলে বাসে চড়া যায়না। খিদেটা একটু বেশিই লেগেছে। অফিসের ঝামেলায় পেট
খালি থেকে গেল। হ্যাঁ, এই গাড়িতেই চড়া যায়। নির্দিষ্ট সিটটাতে বসতে যেন একটু লজ্জা
হচ্ছিল। বাড়ি ফেরার পথে প্রায় সব সহযাত্রী পরিচিতই থাকেন। নির্মলা অনুরোধ করলে
বসতে তেমন অসুবিধে হয়না। অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, কারণ নির্মলা ডাকবেই। শুধু একটু
অপেক্ষা করতে হয়। হলও তাই।
অন্য একটা
পৃথিবীর টানে সে রোজ যাতায়াত করে। বাসটা যেন একটা ডুবোজাহাজ পাতালের পথে চলেছে।
একটা সম্মোহনী সঙ্গীত যেন চারপাশের সবকিছু ঝাপসা করে দেয়। শুধু একবার ভাড়ার জন্য
কন্ডাকটরের হাঁক আর লেনদেন। তারপর স্বপ্নের মত সবকিছু। এভাবেই চলছে আজকাল। নির্মলা
কোনও একটা বেসরকারি সংস্থায় কাজ করে। রোজ খাবার নিয়ে আসে। কখনো ঘর থেকে আবার কখনো
দোকানের।
একদিন নির্মলার
হাত গাড়ির জানলায় দেখতে পেলনা সে। গাড়িতে উঠে আবার নেমে গেল। গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে
গেল। একজন বন্ধু ডেকে বলল, ‘বৌদি পথ চেয়ে আছে, চল।’ কোনও একটা জরুরি কাজ আছে
জানিয়ে সে থেকেই গেল। একটু পরেই এল নির্মলা।
- ‘আমি জানি আপনি থাকবেন। আজ একটু শখ হয়েছে। রেস্তোরাঁয় যাব’।
- কেন?
- আজ আপনার সাথে দেখা হওয়ার তিন মাস হল।
- হ্যাঁ
- আপনার দেরি হলে অসুবিধা নেই তো?
- না না
- বৌদি বকবেনা তো?
- আপনি জানেন?
নির্মলা পৃথিবীময় একটা
মুচকিহাসি ছড়িয়ে দিল।
এরপর সপ্তাহে
অন্তত একদিন বাসের বাইরে দেখা হয়েছে তাদের। খাওয়া দাওয়া, গল্প গুজব।
একদিন নির্মলা
এলনা। বাস থেকে নেমে সে অপেক্ষা করল। কিন্তু নির্মলা এলনা। সন্ধ্যে হয়ে এল। এরপর
কত সন্ধ্যে অপেক্ষায় চলে গেল।
আজকাল রোজ বাড়ি
ফিরতে রাত হয়ে যায় তার। অফিসে এখন দেরি করে আসে, অফিস থেকে দেরি করে ফিরে সে। নাইট গার্ডের
সঙ্গে বসে বিড়ি খায়। ঘরে ফিরে সে হাসিমুখে। বাচ্চাদের জন্য নিয়ে আসে দামি চকোলেট।
গভীর রাতে রোশনকে নিয়ে ছাদে উঠে হাওয়া খায় সে। রোশনের চোখ চকচক করে ওঠে অন্ধকারে।
khub sundor, besh bhalo laglo, I really enjoyed reading the same article, keep it up, best wishes and regards.....
উত্তরমুছুন